Wednesday 15 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যুদ্ধের বুলেট-গ্রেনেড পেরিয়ে লুকার বিশ্বজয়


১১ জুলাই ২০১৮ ২২:৪১ | আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৮ ১৭:০২

। সন্দীপন বসু।

সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার পশ্চিম সীমান্তে পাথুরে পাহাড়ের ধারে ছোট্ট একটি গ্রাম মদ্রিচি। এই গ্রামেই বাস ছিল মদ্রিচ পরিবারের। গ্রামটির গোড়াপত্তন করেছিলেন পশুপালনকারী এই বংশের মানুষরাই। তাই তাদের নামেই গ্রামের নামকরণ। স্বাভাবিক নিয়মে জন্ম আর মৃত্যু নিয়ে কাটছিল সময়। মদ্রিচ পরিবারেই ১৯৮৫ সালে জন্ম নেয় এক শিশু। নাম লুকা জুনিয়র মদ্রিচ। যার বেড়ে ওঠার সময়কে কেন্দ্র করে একসময় প্রায় বদলে যায় ওই গ্রামের মানুষের ভাগ্যের গতিপথ।

বিজ্ঞাপন

ক্রোয়েশিয়ায় লুকার বংশধরদের নামানুসারে রাখা এলাকার নাম

স্থানীয় ক্লাবে খেলেছেন কিশোর লুকা মদ্রিচ

১৯৯১ সাল। ওই বছরের ৭ জুলাই স্বাধীনতা ঘোষণা করে পাহাড়ি জাতি ক্রোয়েটরা। স্নায়ুযুদ্ধের পর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আরও অনেক অঞ্চলের মতো নিজেদের আবাসস্থলকে স্বাধীন ঘোষণা করে নাম রাখে ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু রাজনৈতিক প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ফেরে এই ঘোষণাকে ভালো চোখে দেখেনি প্রতিবেশী শক্তিশালী জাতিগোষ্ঠী সার্বরা। তাদের প্রত্যাশা ছিল নবগঠিত সার্বিয়ায় যোগ দেবে পাহাড়ি ক্রোয়েটরা।

লুকার বাড়ির পেছনে ক্রোয়েশিয়ান সেনাবাহিনীর সতর্কতার চিহ্ন। যা ওই এলাকায় ল্যান্ডমাইন থেকে সাবধান থাকতে বলেছে দর্শনার্থীদের

ওই বছরের মাঝামাঝি লুকাদের গ্রাম দখল করে নেয় সার্বিয়ানরা। সবুজ গ্রামে মাইন পুঁতে তারা। ঘর-বাড়ি জ্বালায়। ১৮ ডিসেম্বরের ঘটনা। ছয় বছরের লুকার দাদা সিনিয়র লুকা কাছের এক পাহাড়ে গবাদিপশু চরাতে গেলে সার্বরা তাকেসহ ধরে নিয়ে যায় ছয় ক্রোয়াটকে, জবাই করে হত্যা করে তাদের। এরপর পাহাড় থেকে নেমে এসে পুড়িয়ে দেয় লুকাদের বহু বছরের পাথুরে ঘরসহ গোটা গ্রাম।

বিজ্ঞাপন

মদ্রিচদের পুড়িয়ে দেওয়া ঘর

এরপরের দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটে দ্রুত। সাজানো গ্রামে ঢুকে সার্বিয়ান সেনাবাহিনী ভয়ংকর অত্যাচার চালায়। ক্রোয়েশিয়াসহ সাবেক যুগোস্লোভিয়ার বেশ কয়েকটি অঞ্চলজুড়ে শুরু হয় বলকান যুদ্ধ। লুকার বাবা জিন্নোভা মদ্রিচ বুঝতে পারেন— সময় ঘনিয়ে এসেছে, না পালালে জীবন বাঁচানো যাবে না। এই জীবন বাঁচানোর সংগ্রামেই উদ্বাস্তু হয়ে যায় মদ্রিচ পরিবার। আশ্রয় নেয় কাছের শহর জাদারের একটি শরণার্থী শিবিরে। আশা করতে থাকেন, একদিন সংকট কেটে যাবে, আবার বাড়ি ফিরবেন তারা। কিন্তু সেই ফেরা আর কোনোদিন হয়ে ওঠেনি মদ্রিচ পরিবারের।

সার্বিয়ান বাহিনীর তোপের মুখে নিজেদের শহর ছেড়ে পালায় অনেক মানুষ

বলকান যুদ্ধের এই ভয়াবহতা নির্মমভাবে বদলে দিয়েছিল লুকা নামে কিশোরটির শৈশব। জাদারের শরণার্থী শিবিরের আশ্রয়কেন্দ্রে বসে ছয় বছরের লুকা দূরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে। শোনে মর্টারের গর্জন আর ক্রমাগত গুলির আওয়াজ। গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত তখন জাদার শহরও। প্রায়ই এদিক-ওদিক ফাটে গ্রেনেড আর বোমা। সেই ভয়ে লুকার বাবা মা তাকে শরণার্থী শিবিরের বাইরে যেতে মানা করে দেন।

ছয় বছর বয়েসী লুকা মদ্রিচ

লুকার শৈশবে শুরু হয় যুগস্লোভিয়ার গৃহযুদ্ধ। দশ বছরব্যাপী এই যুদ্ধ ২০০১ সালে থামে

কিন্তু শরণার্থী শিবিরের কাঁটাতারে মন আটকায় না কিশোর লুকার। সময় কাটানোর জন্য খড়ের ফুটবল বানিয়ে টুকটাক পায়ের কারিকুরি। সেই কারিকুরিই ঠিক ২৭ বছর পরে তার স্বদেশকে টেনে তোলে ফুটবল বিশ্বকাপের মর্যাদাপূর্ণ আসরের সেমিফাইনালে।

মদ্রিচি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে জাদার শহরে বেড়ে ওঠেন লুকা

কিশোর লুকা খেলেছেন ক্রোয়েশিয়ার যুবদলেও

২০১৮ সালে গার্ডিয়ানের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লুকা মদ্রিচ বলেছিলেন, শরণার্থী শিবিরের সবাই যখন আতঙ্কে, প্রাণের ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন, তখন তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ওই খড়ের ফুটবল। বাইরে অবিরাম গুলির শব্দ আর গ্রেনেড ফাটার ভয়াবহতা তিনি ভুলেছিলেন ওই আশ্চর্য গোলকে।

লুকার প্রথম ফুটবল ক্লাবের রেজিস্ট্রেশনের ছবি

আর বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার আগে আরেকটি সংবাদমাধ্যম দ্য মিররকে বলেছেন, এই মুহূর্তে কোনো চাপ, চিন্তা স্পর্শ করছে না তাকে। তিনি বিশ্বকাপ জিততে উন্মুখ। তার শৈশবের ভয়, গ্লানি, একাত্মতা দিয়ে তিনি চান বিশ্বকাপ জয় করে দেশকে সম্মানিত করতে। সত্যিই তো, যে ছোট্ট ছেলেটিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি বুলেট আর গ্রেনেড, তাকে কি কোনোভাবে আটকে রাখা যায়! আর তাই ৫২ বছর পরে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপের স্বপ্নে বড় বাধার নাম ক্রোয়েশিয়ার এই হার না মানা ছেলেটিই। লুকা মদ্রিচকে ঠেকানোর চিন্তাই বোধহয় এখন সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে ইংল্যান্ডকে।

বলকান যুদ্ধের নির্মমতায় প্রাণ হারায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। শরণার্থী শিবিরে তাদের স্বজনদের আহাজারি

গার্ডিয়ানের কাছে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে লুকা মদ্রিচ বলেছিলেন, ‘আমি যুদ্ধের দিনগুলো ভুলতে পারি না। ক্রোয়েশিয়ার মানুষ অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। আমার পরিবারও। আর ওই কষ্টই আমাদেরকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করেছে। খুব খারাপ অবস্থাতেও লড়াইয়ের শক্তি জুগিয়েছে।’ সেই শক্তি নিয়েই রাশিয়ায় খেলতে এসেছিলেন লুকা।

কিশোর লুকা স্বপ্ন ছিল বহুদূরে যাওয়ার। জাদার শহরে ডিনাগো জাগরেব ক্লাবে তরুণ তারকা হিসেবে খেলতে শুরু করেন তিনি

সেমিফাইনালে ওঠার পর সংবাদমাধ্যমকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধের সময় ক্রোয়েশিয়ানদের সবকিছু হারানোর কষ্টের দিনগুলোর কথা। বলেছেন, এবারের বিশ্বকাপেও কেউই ক্রোয়েশিয়াকে আলোচনায়ই আনেনি। আর সেটাই জেদ বাড়িয়েছিল। আর এখন ইতিহাসের অংশ হওয়ার ম্যাচে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হওয়ার আগে সেই জেদ নিশ্চয়ই এগিয়ে রাখবে অধিনায়ক লুকাকে আর পুরো ক্রোয়েশিয়াকেও।

প্রত্যয়ী লুকা

লুকার স্ত্রী ভানজা বসনিক ও ছেলে ইভানো

রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্বাদ পেয়েছেন লুকা মদ্রিচ

 

সারাবাংলা/ এসবি

 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর