ঠাকুরগাঁও : আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শুধু ভোটযুদ্ধ নয়, এ যেন এক অগ্নিপরীক্ষা। এটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মহাসচিব, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জন্য এক ‘কঠিন চ্যালেঞ্জ’। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে ঘোষিত ২৩৭ জন প্রার্থীর তালিকায় উঠে এসেছে ঠাকুরগাঁও-১ আসন থেকে তার নাম। তার দীর্ঘদিনের আপসহীন রাজনৈতিক লড়াইয়ের এক প্রতিচ্ছবি। এটি কেবল একটি সংসদীয় আসন নয়, এটি তার জন্মভূমি, তার রাজনৈতিক ক্যানভাস, যেখানে তিনি তার জীবনের শেষ নির্বাচন লড়তে চলেছেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমি ঠাকুরগাঁও থেকে বারবার মনোনীত হয়েছি। কখনও জিতেছি, কখনও হেরেছি, কিন্তু কখনও জনগণকে ছেড়ে যাইনি।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘এটাই আমার জীবনের শেষ নির্বাচন। আমি মানুষের জন্য কিছু করতে চাই।’
ফখরুলের এই নির্বাচন তাই কেবল জয়-পরাজয়ের হিসেব নয়; এটি জাতীয় রাজনীতিতে তার অবস্থান, দলের মনোবল এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পথে তার ত্যাগের এক জলন্ত উদাহারণ।
আওয়ামী লীগের দুর্গে আঘাত হানার চ্যালেঞ্জ
ঠাকুরগাঁও-১ আসনটি বরাবরই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতার কেন্দ্র। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে আসনটি আওয়ামী লীগের ‘দুর্গ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে এই শক্ত প্রাচীর ভেঙে দলের বিজয় ছিনিয়ে আনার গুরুভার ফখরুলের কাঁধে। যদিও এখনো পর্যন্ত এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ
সংখ্যালঘু ও আদিবাসী ফ্যাক্টর: এলাকার মোট ভোটারের একটি বড় অংশ সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। ঐতিহ্যগতভাবে এই ভোটব্যাঙ্ক আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকলেও, মির্জা ফখরুলের ‘ক্লিন ইমেজ’ এবং স্থানীয়দের সঙ্গে তার সুগভীর সংযোগ বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু পরাজয়ও তাকে স্পর্শ করেছে। তবে এবারের লড়াইটি ভিন্ন। এটি তার শেষ সুযোগ নিজের জীবনের দীর্ঘ রাজনৈতিক অধ্যবসায়কে জনগণের ম্যান্ডেটে পরিণত করার।
ত্রিমুখী চাপ ও কঠিন সমীকরণ
মির্জা ফখরুলের চ্যালেঞ্জ কেবল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নয়, এবার ভোটের মাঠে তাকে ত্রিমুখী চাপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা দক্ষিণের সহকারি সেক্রেটারি, ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি দেলাওয়ার হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন এই আসনে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতের এই উপস্থিতি বিএনপিবিরোধী ভোটকে দুর্বল করার চেয়ে বরং ফখরুলের ঐতিহ্যবাহী ভোটব্যাঙ্কেই ফাটল ধরাতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, জোটের রাজনীতি এবং নিজের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি-র মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। তবে স্থানীয়দের দাবি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির তীব্রতা সত্ত্বেও, জামায়াত মির্জা ফখরুলের ব্যক্তিগত প্রভাব ও প্রজ্ঞার কাছে ধোপে টিকবে না। জনমানুষের হৃদয়ে তার অবস্থান অনেক গভীরে।
দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, দলটির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি সংগ্রামে আপসহীন নেতৃত্ব, জেল-জুলুম-নির্যাতন তাঁকে রাজনৈতিক ময়দানে নিখাদ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি এলাকার মানুষের শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
আশা ও আস্থার প্রতীক ফখরুল
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুধু একজন মহাসচিব নন, তিনি দীর্ঘ সংগ্রাম, কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগের প্রতীক। স্থানীয় পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, এই গুণগুলোই তাঁকে জাতীয় রাজনীতির শীর্ষে ঠেলে দিয়েছে। স্থানীয়দের মাঝে তাকে ঘিরে উন্নয়নের নতুন স্বপ্ন দানা বেঁধেছে।
যদিও তার অতীত কর্মজীবন নিয়ে এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, মন্ত্রী থাকাকালে আশানুরূপ আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। তবে সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্রসেনের দুর্নীতি ও কুকীর্তির অভিযোগের বিপরীতে ফখরুলের উপর মানুষের ভরসা বহুগুণ বেড়েছে। মানুষের চোখে তিনি এখন আশা ও আস্থার কেন্দ্রবিন্দু।
দ্বৈত চ্যালেঞ্জ: দল ও নিজের আসন
বিএনপির বর্তমান মহাসচিব হিসেবে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া এবং একইসাথে নিজের আসনে জয় নিশ্চিত করা। এই দ্বৈত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে ফখরুলকে। ঠাকুরগাঁও-১ আসনে তার জয় কেবল তার ব্যক্তিগত বিজয় হবে না, বরং এটি দলের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তাঁর অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করবে এবং দলের সামগ্রিক মনোবলের জন্য তা অপরিহার্য।
এই নির্বাচন তার জীবনের এক চরম লগ্নের প্রতিফলন। তিনি প্রমাণ করতে চাইবেন, প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি জনগণের ম্যান্ডেট ছিনিয়ে আনতে সক্ষম। রাজনীতি ও ভোটের মাঠের এই জটিল সমীকরণই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এক কঠিন ‘অগ্নিপরীক্ষার’ মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। জাতীয় রাজনীতি তার দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ এই আসনে তার জয়-পরাজয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে এক গভীর রেখা টেনে দেবে।