ঢাকা: কয়েক মাস আগেই নতুন করে কার্পেটিং করা সড়ক হঠাৎ-ই ভেঙে ফেলা হচ্ছে; কখনও ওয়াসার পাইপলাইন, কখনও গ্যাসলাইন, আবার কখনও বিদ্যুৎ কিংবা টেলিফোন ক্যাবলের অজুহাতে একের পর এক সড়ক খুঁড়ছে বিভিন্ন সংস্থা। ফলে বছরের পর বছর একই সড়কে একাধিকবার খোঁড়াখুঁড়ির ফাঁদে ভোগান্তির শিকার নগরবাসী। তাদের প্রশ্ন, এই খোঁড়াখুঁড়ির শেষ কোথায়? তবে কি টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা কেবল-ই কাগজে কলমে?
সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে রাস্তার ধূলোবালি, যানজট ও দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তিতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। অফিসগামী থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, নারী-শিশু-বৃদ্ধ সবাইকে পড়তে হচ্ছে বিপাকে। সেইসঙ্গে ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং হারাচ্ছেন উৎপাদনশীল সময়। এভাবেই প্রতিবছর রাষ্ট্রের কোটি কোটি সড়ক সংস্কারে খরচ হচ্ছে। কিন্তু মিলছে না টেকসই সমাধান।
রাজধানীর মিরপুর ১২ ও ১০ নম্বরে, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও যাত্রাবাড়ীসহ আরও বেশকিছু এলাকায় সম্প্রতি চলে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। কোথাও কোথাও এখনো চলছে। সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কগুলোতে ড্রেনের নতুন পাইপ বসানোর কাজ চলছে। যা বলতে গেলে প্রতিবছরই খোঁড়াখুঁড়ি করে বসানো হয়। ফলে তীব্র যানযটসহ নানান ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ মানুষদের। এছাড়া, প্রতিবছর-ই পাইপ বসানোর কারণে নষ্ট হচ্ছে সরকারি অর্থ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির প্রধান কারণ হলো সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। রাস্তা বানানোর আগে ওয়াসা, টেলিকম, গ্যাস কিংবা বিদ্যুতের সংস্থাগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে পরিকল্পনা করার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা খুব কমই হয়। ফলে একবার সড়ক নির্মাণ বা সংস্কারের পর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অন্য সংস্থা আবার একই জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে।

এভাবেই রাজধানী ঢাকায় সংস্কারের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলে বছরজুড়ে। ছবি: সারাবাংলা
তাদের অভিমত, সমাধান একটাই- সেটা হলো সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান। এক ছাতার নিচে সব ইউটিলিটি সংস্থাকে এনে আগে থেকেই রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। কোন এলাকায় কোন সংস্থার কাজ কখন হবে, সেটা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। উন্নত দেশগুলোতে রাস্তা নির্মাণের আগে মাটির নিচে পাইপলাইন, ক্যাবল, ড্রেনেজ সিস্টেম একবারে স্থায়ীভাবে বসানো হয়। ফলে রাস্তায় বারবার খোঁড়াখুঁড়ির দরকার পড়ে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সড়ক সংস্কার (নালা ও ফুটপাত নির্মাণসহ) কাজে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটের ৩৩ শতাংশ সড়ক ও অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সড়ক সংস্কার (উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, ফুটপাত) কাজে ৬৪৪ কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ছিল ৬০২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। তবে উভয় সিটি করপোরেশনে সড়কের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা শুধু শুধুই খরচ হচ্ছে।
কাজীপাড়ার রিকশাচালক আলমগীর হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাস্তা একটু ভালো হইলেই আবার খুঁইড়ে ফেলে। সারাদিন ট্র্যাফিকে বসে থাকতে হয়, তাই যাত্রীও নেমে যায়। এজন্য আমাদেরও আয় রোজগারও কমে গেছে।’ মিরপুর ১০নম্বরে অফিসগামী রুনা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সময়মতো অফিসে যেতে পারছি না। রাস্তায় কাজ চলতে থাকলে যাতায়াতের কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকে না। বাচ্চাদেরও স্কুলে যেতে কষ্ট হচ্ছে।’
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে কথা হয় আরিফ হোসেনের সঙ্গে। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘এই এলাকায় এমনিতেই যানযট থাকে। তার ওপর এখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করলে হেঁটে চলাচল করতেও খুবই কষ্ট হয়। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে পায়ে হাঁটারও পর্যাপ্ত জায়গা থাকে না। প্রতিবছর আমাদের টাকাগুলো এভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির নামে অন্যের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটা ইন্ডিকেটেড প্ল্যান, একটা ওয়ান স্টপ সার্ভিস থাকা দরকার। সিটি করপোরেশনের কমিটির মাধ্যমে ইউলিটি সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট তারা আমাদের অনুমতিও নেয়। আমরা সতর্ক থাকার চেষ্টা করি যে, একই রাস্তায় যেন একাধিকভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করতে না পারে এবং চলাচলে বিঘ্নিত না হয়। তাদের ঠিকাদার কাজ করার পরে কোনো গ্যাপ থাকলে আমাদের লোকজন এটাকে রিপেয়ারিং করে। রিপেয়ার করার ক্ষেত্রে অনেক সময় আননেসারি কিছু বিষয় উদ্ভব হয়; সে কারণেও সময় মতো এটা হয় না। আমরা দুই পক্ষের সমন্বয়ের মাধ্যমে যথাসম্ভব এগুলো এখন সুন্দরভাবে করার চেষ্টা করছি।’
প্রতিবছরই টেকশই পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছেম কিন্তু সেটা কাজে লাগছে কি না?- এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এবার খোঁড়াখুঁড়িটা একেবারে কম। আমরা সেভাবে অনুমতি দিচ্ছি না। যদি দিইও তাহলে একটা কাজের জায়গায় ডুয়েল কোন কাজ থাকলে সেটা যেন একবারে সমাধান হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা কাজ করার চেষ্টা করছি। আগে যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি হতো, সেখান থেকে অনেকটাই কমিয়ে নিয়ে আসছি।’

এভাবেই রাজধানী ঢাকায় সংস্কারের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলে বছরজুড়ে। ছবি: সারাবাংলা
ড্রেনের পাইপ বসানোর জন্য প্রতিবছর সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করা হচ্ছে এবং এবারও এই কাজ চলছে। আর এ কারণে দেশের বাজেট ও জনগণের টাকাও নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার মিরপুর ১০নম্বর থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত ২ দশমিক ৮ কিলোমিটারে ড্রেনের নেটওয়ার্ক কখনও ছিল না। এটা না থাকার কারণে কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ায় পানি জমে থাকে। আমি এসে এখানে ড্রেনের নেটওয়ার্ক শুরু করেছি।’
তার অভিযোগ, ‘এর আগে এতগুলো মেয়র গেছে এটা নিয়ে কেউ ভাবেও নাই, করেওনি। শুধু জলাবদ্ধতা যখন হয়েছে, তখন তারা বিব্রত হয়েছে। সমাধান তাদেরে জানা ছিল না। আর হোপ স্কুলের গলিতেও কাজ চলছে, ওখানেও ড্রেনের নেটওয়ার্ক নাই। শীতকালেও এখানে ছয় ইঞ্চি পরিমাণ পানি থাকে। আর ওখানের রাস্তাটাই খারাপ, কার্পেটিং করার পর কাটা হচ্ছে না। মিরপুর ১২ নম্বরের ডি-ব্লকে রাস্তা কেটে ড্রেনের পাইপ বসানোর বিষয়ে আমার জানা নাই। খবর নিয়ে দেখব এটা কী অবস্থায় রয়েছে।’
রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কন্ট্রাক্টররা যে ধরনের কাজ করে তাদের মানগুলো এত খারাপ থাকে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলো এক-দুই বছরও টিকে না। এখানে দুর্নীতির পরিমাণটা খুব বেশি। দুর্নীতি করতে করতে দেখা যায়, যে টাকা দিয়ে কাজগুলো করার কথা, তার অর্ধেক টাকাও সেখানে ব্যয় করা হয়নি। নিম্নমানের যে কাজ হয় সেটা যাদের মনিটরিং করার কথা তারা কিন্তু এই কনস্ট্রাকশন অডিট করে না। এমনকি, তাদের ফের খোঁড়াখুঁড়ি প্রকল্পের জন্য অন্তর্ভুক্ত করে। যারা নিম্নমানের কাজ করে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা দরকার। এটা করা হলে তারা আর কোনো দিন কাজ পেত না। এটা একটা চক্রের মতো। তারা দিনের পর দিন নিম্নমানের কাজ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে জনগণের ভোগান্তি এবং আমাদের ট্যাক্সের টাকা অপচয় হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনার পাশাপাশি যারা কনস্ট্রাকশন করছে তারা কী মান দেবে এবং সেটা কয়বছর স্থায়িত্বশীল হবে এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ডিটেইল গাইডলাইন তৈরি উচিত। গাইডলাইন থাকলে কাজগুলো নিয়ে ভোগান্তিটা হতো না। যে কোনো কাজ করতে গেলে তার একটা নির্দিষ্ট লাইফটাইমের বিষয় থাকে। আমি কী জন্য পাইপ বানাচ্ছি, তার লাইফটাইম কত হবে এবং এটা চুক্তির মধ্যে থাকতে হয় যে। আমাদের চুক্তিগুলোতে এই জিনিসগুলো ভালোভাবে থাকে না এবং পরবর্তী সময়ে সেগুলো নিয়ে কাজ করতে সেভাবে বাধ্য করা হয় না। ফলে চুক্তিগুলো অসম্পূর্ণ থেকে যায়।’
খোঁড়াখুঁড়ির নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই। এক সংস্থা চলে গেল, আরেক সংস্থা হাজির। সব মিলেই এটা একটা চক্র। এই চক্র যে প্রকল্পে টাকা-পয়সা বাড়ানো যায় সেই প্রকল্প নিয়ে কাজ করে। যতক্ষণ তাদের চিহ্নিত করা না যাবে এবং অডিটিং নিশ্চিত না হবে- এটা চলতেই থাকবে।’