ঢাকা: তারল্য সঙ্কটের কারণে গত এক বছরে (অক্টোবর ২০২৪-অক্টোবর ২০২৫) ব্যাংক খাতে কলমানি ঋণ বেড়েছে ৬৩ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে শুধু ওভার নাইট ধার বেড়েছে ৪৯ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক রেপোতে ধার বেড়েছে ৫৮ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের গত অক্টোবরে কলমানিতে একদিনে থেকে এক বছরের রকম সময়ের জন্য ধার নেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এটি গত অর্থবছরের একই মাসে ছিল ৮০ হাজার ২৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাস থেকে মাসের ভিত্তিতে এক বছরের ব্যবধানে কলমানিতে ধার বেড়েছে ৬৩ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা।
অন্যদিকে একদিনের জন্য ওভার নাইটে ধার চলতি বছরের গত অক্টোবরে ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের অক্টোবরে ছিল ৭২ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ওভার নাইট ধার বেড়েছে ৪৯ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ২ থেকে ১৪ দিনে জন্য শর্টনোটিশে ধারের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। যা গত অর্থ বছরের একই মাসে ছিল ৬ হাজার ৫৪১ কোটি টাক। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে (মাস থেকে মাসে) ধারের পরিমাণ বেড়েছে ১২ হাজার ৯২২ কোটি টাকা।
একইভাবে ১৫ দিন থেকে এক বছরের কম সময়ের জন্য টার্ম কল ঋণ গত অক্টোবরে ছিল ১ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। যা ২০২৪ সালের অক্টোবরে ছিল ১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে অক্টোবর-টু-অক্টোবর সময়ে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ৩৯৪ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে চড়া সুদে স্বল্পকালীন ঋণ করায় অধিকাংশ ব্যাংকে এখন অস্বস্তিকর সময় পার করছে।
বিগত সরকারের সময় ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে ব্যাংকগুলো নগদ তারল্য সঙ্কটে ভুগছিল। সে সময় তারল্য ঘাটতি পূরণে ব্যাংকগুলো নিরুপায় হয়ে স্বল্পকালীন আন্ত:ব্যাংক ঋণ (কলমানি)-এর দিকে অধিক ঝুঁকে পড়েছিল। আর চলতি বছরের গত অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে এটা অনেকটা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
তবে অধিক দুর্বল ব্যাংকগুলো সরকারি তারল্য সহায়তা পাওয়ায় তারা কলমানিতে ধার কম নিচ্ছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সারাবাংলা-কে বলেন, ‘পলিসি রেট বাড়ার প্রভাব কলমানি মার্কেটে পড়েছে। এখন ঋণের খরচ বেড়েছে। অনেক ব্যাংক নগদ টাকার চাপ সামলাতে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখে সুনাম ধরে রাখার চেষ্টা করছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিনিয়োগ কমায় ঋণের চাহিদা কমেছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি সারাবাংলা-কে বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সঙ্কট রয়েছে। ডলারের দাম বাড়ায় ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তারল্য সঙ্কট মোকাবিলায় এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিচ্ছে। কারণ বাজারে খুব বেশি তারল্য নেই। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকও রেপোর নিলাম কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো খুব বেশি টাকা ধার করতে পারছে না। সব মিলে কলমানি বাজারে চড়া সুদে যেসব ব্যাংক টাকা ধার নিয়ে ধার পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে কলমানিতে সুদহার বেশি হলেও নিরুপায় হয়ে কলমানিতে লেনদেন করে অস্বস্তিতে রয়েছে ব্যাংকগুলো।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অক্টোবরে কলামানির মধ্যে ওভার নাইটের গড় সুদ হার (ডব্লিইএআর) ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, শর্ট নোটিশের গড় সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং টার্ম কলে সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর আন্ত:ব্যাংক রেপোতে সুদের গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
আর চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের অক্টোবর মাসে আন্ত:ব্যাংক লেনদেনের (কলমানি) পরিমাণ ছিল ৭১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের একই মাসে ছিল ১৩ হাজার ৩২ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৫৮ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি দুর্বল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘এখন শুধু কয়েকটি ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। তবে অন্য ব্যাংকগুলো ব্যাংক দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, তারাই ধার নিচ্ছে। এখন যেসব ব্যাংকের ধার প্রয়োজন, তাদের বেশির ভাগেরই পর্যাপ্ত জামানত নেই। তারা কলমানির ধারের টাকায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকারের পালাবদলের পর নতুন নীতিমালায় নেওয়ায় বিশেষ তারল্য সহায়তা (এসএলএফ) সুবিধা চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ছিল মাত্র ১৮ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই মাসে ছিল ৭০ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে অক্টোবর থেকে অক্টোবর এক বছরের ব্যবধানে এসএলএফ সুবিধা কমেছে ৫২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘ডলারের কদর বেড়েছে। এতে টাকার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। এতে কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলো তারল্য সুবিধা নিচ্ছে। স্বাভাবিক চাহিদা পূরণে কলমানিতে ধার করছে। যার পুরোটা বাজারের ওপর নির্ভর করে। চাহিদা বাড়লে ধার বাড়ে, আবার চাহিদা কমলে ধার কমে।’