পিরোজপুর: কাদা, পিচ্ছিল পথ আর ভাঙাচোরা সেতুর কারণে বছরের পর বছর যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরবস্থা। বর্ষা এলেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের সংযোগ। সরকারি বরাদ্দের প্রত্যাশা বা জনপ্রতিনিধির আশ্বাস—এসব পেরিয়ে এবার নিজেরাই উন্নয়নের পতাকা তুলেছে পিরোজপুরের নেছারাবাদের একদল তরুণ।
স্বরূপকাঠি উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের ৩০ তরুণের হাত ধরে শুরু হয় এক অনন্য উদ্যোগ—‘সবার আগে বলদিয়া’। তাদের স্বপ্ন ছিল একটাই, নিজেদের গ্রামের উন্নয়ন নিজেরাই করবে। আর সেই ভাবনা থেকেই জনপ্রতিনিধি বা সরকারি বরাদ্দ ছাড়াই তারা স্বেচ্ছাশ্রমে এখন পর্যন্ত ৩০টি সেতু সংস্কার ও নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেছেন।

ভাঙাচোরা সড়ক ও অকেজো সেতুগুলো স্থানীয় তরুণ ও যুবকদের স্বেচ্ছাশ্রমে নতুনভাবে তৈরি করা হচ্ছে। ছবি: সারাবাংলা
বলদিয়া ইউনিয়নের চামি ৩ নম্বর ওয়ার্ডের একতা বাজার থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত এলজিইডির অধীনে প্রায় তিন কিলোমিটার সড়কে দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ ছিল তিনটি পুল (ছোট সেতু)। এই রাস্তা দিয়ে কোনো রোগী পরিবহন বা পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল করতে পারত না। একবার রাস্তাটির পুলসহ পুরো রাস্তার জন্য টেন্ডার হলেও সরকার পরিবর্তনের পর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা গাছ ও বাঁশের সাহায্যে পুলগুলোতে জোড়াতালি দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতেন। গত শনিবার ‘সবার আগে বলদিয়া’ সংগঠনের সদস্যরা সারা দিন স্বেচ্ছাশ্রমে এ তিনটি পুল সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করেন। এতে রাস্তাটি পুনরায় সচল হওয়ায় এলাকাবাসীর মুখে হাসি ফোটে।
গ্রামের প্রবীণ ও স্থানীয় ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, ‘উন্নয়নের নামে আমরা শুধু আশ্বাস শুনেছি। কিন্তু এই তরুণরা দেখিয়ে দিয়েছে, চাইলে মানুষ নিজেরাও পরিবর্তন আনতে পারে। তারা আমাদের এলাকার গর্ব।’
একই ইউনিয়নে অবস্থিত বলদিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে ৬০ ফুট লম্বা একটি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সেটি পার হতো। সংগঠনের উদ্যোগে সেটি সংস্কার করা হলে এখন শিক্ষার্থীরা নিশ্চিন্তে চলাচল করছে। বিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলে, ‘আগে সেতু পার হতে ভয় লাগত, এখন মনে হয় নতুন রাস্তা পেয়েছি।’
উপজেলার সমুদয়কাঠি ইউনিয়নের সাগরকান্দা বাজার থেকে জিনুহার গ্রাম পর্যন্ত সড়কেও একই ধরনের কাজ করেছে সংগঠনটি। নাথপাড়া এলাকায় স্কুল, মসজিদ ও মন্দিরসংলগ্ন তিনটি পুল প্রায় ১৫ বছর ধরে ভাঙাচোরা অবস্থায় ছিল। সম্প্রতি সংবাদ প্রকাশের পর সংগঠনের নেতা মো. মাসুদ পারভেজ ও সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে সেখানে নতুন করে তিনটি সেতু নির্মিত হয়।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পিরোজপুর-২ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আহম্মেদ সোহেল মঞ্জুর সুমন তিনটি সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ দিয়েছিলেন। আমরা সেই অর্থে পাঁচটি সেতু করেছি। এ ছাড়াও আমরা আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্থায়ন ও স্বেচ্ছাশ্রমে ২৫টি সেতু সংস্কার করেছি।’
সংগঠনের সভাপতি মো. মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘প্রথমে নিজেদের অর্থায়নে ২২টি সেতু সংস্কার করেছি। পরে সোহেল মঞ্জুর সুমন সাহেবের সহায়তায় আরও পাঁচটি নতুন সেতু করেছি। শনিবার চামি গ্রামে আরও তিনটি সেতু সংস্কার শেষে আমাদের মোট কাজের সংখ্যা ৩০-এ পৌঁছেছে। শুরুতে সদস্য ছিল ৩০ জন, এখন শতাধিক তরুণ আমাদের সঙ্গে কাজ করছে।’
নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এই তরুণদের কাজ সত্যিই প্রশংসনীয় ও অনুকরণীয়। যদি অন্য ইউনিয়নের তরুণরাও তাদের মতো উদ্যোগ নেয়, তাহলে গ্রামীণ উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। প্রশাসন থেকেও আমরা তাদের পাশে থাকব।’