ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও শিল্পকারখানার নির্গমন—সব মিলিয়ে ঢাকা শহরের বাতাসে এখন বিষ মিশে আছে। এক সময়ের সবুজ ঢাকা আজ বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরের তালিকায় নিয়মিত অবস্থান করছে।
সোমবার (১০ নভেম্বর) সকাল ৯টার তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের সূচকে ঢাকার একিউআই (AQI) স্কোর ২৬০, যা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’।
এর মানে হলো—এই বাতাসে শ্বাস নেওয়া মানেই শরীরের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি।
দিল্লি ও লাহোরের পরেই ঢাকা
সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি মেগাসিটি—দিল্লি, লাহোর ও ঢাকা বায়ুদূষণে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সোমবারের তথ্য অনুযায়ী, ৫৬৪ স্কোর নিয়ে ভারতের রাজধানী দিল্লি বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষে। দ্বিতীয় স্থানে পাকিস্তানের লাহোর, যার স্কোর ৩২৪। আর ঢাকার অবস্থান তৃতীয়, ২৬০ স্কোর নিয়ে।
এ তিন শহরের বাতাসেই মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন এখন হুমকির মুখে।
বৃষ্টির স্বস্তি ক্ষণস্থায়ী
সাম্প্রতিক কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ঢাকার আকাশ কিছুটা স্বচ্ছ দেখালেও, সেটি ছিল সাময়িক স্বস্তি মাত্র। বৃষ্টি শেষ হতেই আবারও ধুলো, ধোঁয়া, ও যানজটের ধোঁয়াশায় ঢেকে গেছে নগরীর বাতাস।
পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক কর্মকর্তা ড. শাহনাজ ইসলাম বলেন, “ঢাকার বায়ুদূষণ মৌসুমি নয়, এটি এখন স্থায়ী সংকটে পরিণত হয়েছে। নির্মাণকাজ, যানবাহন ও ইটভাটা—এই তিনটি মূল উৎস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।”
কেন এতো খারাপ ঢাকার বাতাস?
ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান পাঁচটি উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে:যানবাহনের ধোঁয়া –পুরোনো গাড়ি, অনিয়ন্ত্রিত জ্বালানি ব্যবহার। নির্মাণকাজের ধুলা–উন্মুক্ত স্থাপনা, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। ইটভাটা–শীত মৌসুমে গ্রামীণ প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা হাজারো চুল্লি। শিল্পকারখানা–বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও খোলা চিমনির ধোঁয়া। গৃহস্থালি জ্বালানি ও বর্জ্য পোড়ানো–নিম্নআয়ের এলাকায় প্রধানত ব্যবহৃত কাঠ, কয়লা ও প্লাস্টিক পোড়ানো।
এগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে পিএম২.৫ (সূক্ষ্ম ধূলিকণা) ও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের ঘনত্ব বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
মানবদেহে ধীরে ধীরে বিষের ছাপ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বায়ুদূষণজনিত কারণে মারা যায়। বাংলাদেশেও এর প্রভাব ভয়াবহ—বিশেষ করে শিশু, প্রবীণ, এবং শ্বাসকষ্ট বা হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য।
বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়—অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্ট,ফুসফুসের ক্যানসার,হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক,গর্ভস্থ শিশুর বিকলাঙ্গতা ও অকাল জন্ম।
করণীয়:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।
যানবাহনের ধোঁয়া কমাতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারে উৎসাহ।
নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত পানি ছিটানো ও ঢেকে রাখা।
ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তি ও নির্গমন নিয়ন্ত্রণ।
বর্জ্য না পোড়ানো, বরং পুনর্ব্যবহার।
শহরে সবুজ বেষ্টনী ও গাছ লাগানোর উদ্যোগ।
বায়ু, পানি ও মাটি—মানুষের টিকে থাকার মূল উপাদান। কিন্তু ঢাকার বাতাস এখন এমন এক অদৃশ্য শত্রু, যা প্রতিদিনই নাগরিকদের নিঃশব্দে আঘাত করছে। স্বপ্নের শহর ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—পরিষ্কার বাতাস ফিরিয়ে আনা।