Monday 10 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফ্লেভার আসক্তিতে তরুণ-তরুণীরা
জনস্বাস্থ্যে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে সুগন্ধি সিগারেট

এমদাদুল হক তুহিন সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১০ নভেম্বর ২০২৫ ২৩:২৫ | আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৫ ০০:০৯

জনস্বাস্থ্যে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে সুগন্ধি সিগারেট। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: বর্তমানে বিশ্বে ধূমপায়ীর সংখ্যা ১২০ কোটির বেশি। আর ধূমপানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে সারা বিশ্বে প্রতিবছর মারা যায় ৮০ লাখ মানুষ। ধূমপান ক্ষতি জেনেও কমছে না ধূমপায়ীর সংখ্যা। আশঙ্কার বিষয় হলো, ধূমপানের অনুষঙ্গে যুক্ত হয়েছে সুগন্ধি সিগারেট। যা সাধারণ সিগারেটের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, দেশে সুগন্ধি সিগারেটের প্রসার বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ তরুণ-তরুণীরা এসব সিগারেটে আকৃষ্ট হয়ে উঠছে। একইসঙ্গে কর্পোরেট শ্রেণির অনেকেই এখন সুগন্ধিযুক্ত সিগারেটে ঝুঁকছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ সিগারেটের চেয়ে সুগন্ধি সিগারেট বেশি ক্ষতিকর। সুগন্ধি সিগারেট শ্বাসতন্ত্রের ক্যানসারের একটি বড় কারণ। এছাড়া মুখগহ্বর, ফুসফুসের অ্যালার্জি ও ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকিও কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে।

বিজ্ঞাপন

তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো বলছে, নতুন ভোক্তা তৈরি করতে তামাক কোম্পানিগুলো কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুগন্ধি সিগারেটে আগ্রহী করে তুলছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সুগন্ধি সিগারেট নিষিদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীতে সুগন্ধি সিগারেট ও ই-সিগারেট নিষিদ্ধের বিয়ষটি অন্তর্ভুক্ত করে মাঠ পর্যায়ে এই আইনের সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি। প্রয়োজনে যেসব দোকানে এসব সিগারেট বিক্রি হয়, তাদের লাইসেন্সিংয়ের আওতায়ও আনা যেতে পারে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ও মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে এসব তথ্য জানা গেছে।

সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ভিন্ন ফ্লেভার বা গন্ধ যুক্তযুক্ত সিগারেট-ই সুগন্ধি সিগারেট নামে পরিচিত। সিগারেটের স্বাভাবিক গন্ধ পরিবর্তন করতে এসব সিগারেটে ফল, ভেষজ বা অন্যান্য উপাদানের স্বাদ ও সুগন্ধ যুক্ত করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুগন্ধি সিগারেট নিষিদ্ধ থাকলেও বাংলাদেশের আইনে তা এখনও নিষিদ্ধ নয়। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও তামাকবিরোধী সংগঠগুলোর মতে, বিশ্বের ৪০ থেকে ৫০টির মতো দেশে সুগন্ধি সিগারেট নিষিদ্ধ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের বাজারে বেশ কিছু ব্র্যান্ডের আপেল, স্ট্রবেরি ও চকলেট স্বাদের সুগন্ধি সিগারেট রয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাজারে ‘এরিস’ নামের একটি সুগন্ধি সিগারেটের দেশীয় ব্র্যান্ড রয়েছে। আবুল খায়ের গ্রুপের এই ব্র্যান্ডের আপেল ও স্ট্রবেরি স্বাদের সিগারেট বাজারে বিক্রি হতে দেখা গেছে। ২০ শলাকার এই ব্র্যান্ডের প্যাকেটের দাম ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। ‘মন্ড’ নামের অপর একটি ব্র্যান্ডের চকলেট, স্ট্রবেরি ও আপেলের সুগন্ধিযুক্ত সিগারেট বাজারে বিক্রি হতে দেখা গেছে। এই ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্রতি প্যাকের দাম ১৬০ টাকা। এছাড়া ‘এলিগেন্স’ নামের অপর একটি ব্র্যান্ডের চকলেটের স্বাদযুক্ত সিগারেট বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এর ২০ শলাকার প্রতিটি প্যাকেটের দাম ১৮০ টাকা। এছাড়া বাজারে বেনসন, মার্লব্রো, গোল্ডলিফ, ক্যামেল, লাকি ও নেভি নামের প্রতিটি ব্র্যান্ডের মেনথল ও সুইচ নামের সিগারেট বাজারে রয়েছে, যা সুগন্ধি সিগারেটের আওতায় পড়ে বলে তামাক সংশ্লিষ্টরা জানান। ব্র্যান্ডভেদে এসব সিগারেটের প্রতিটির প্যাকেট ১৬০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।

রাজধানীর গুলশানে ওয়েস্টিন হোটেলের পাশের সিগারেটের দোকানদার মো. হাফিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুগন্ধী সিগারেট ধনী ও তরুণ শ্রেণির লোকজন বেশি খায়। মেয়েরাও এসব সিগারেটে আগ্রহী।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এনবিআরের লোকজন আসে। মাঝে-মধ্যে এসে বিদেশি সিগারেট পেলে নিয়ে যায়। ফলে এখন আর বিদেশি সিগারেট বিক্রি করি না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি দোকানেই সুগন্ধি সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাও রয়েছে অনেক। তরুণ-তরুণীদের একটি অংশ সুগন্ধি সিগারেট সেবন করছেন। টিএসসি এলাকার সিগারেটের দোকানি শুক্কুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘মন্ডের স্ট্রবেরি ও গ্রিন আপেল এবং এরিসের আপেল ও স্ট্রবেরি ফ্লেভারের সিগারেট রয়েছে। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এসব সিগারেট কিনে থাকেন। পাশাপাশি টিএসসি এলাকায় আড্ডা দিতে আসা মধ্যবয়সী যুবকরাও এসব সিগারেট কিনে থাকেন। সবমিলিয়ে ক্রেতা ভালোই রয়েছে। তবে তরুণীরা এসব সিগারেটে বেশি আগ্রহী।’

টিএসসি এলাকায় ধূমপান করছিলেন তিন শিক্ষার্থী। একসঙ্গে ধূমপান করা এই গ্রুপটিতে একজন নারী শিক্ষার্থীও ছিলেন। মন্ডের স্ট্রবেরি ফ্লেভারের সিগারেট টানছিলেন তিনি। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মন্ডের স্ট্রবেরি ফ্লেভারটি আমার কাছে ভালো লাগে, গন্ধ নেই। ফলে এটি টানার পরও কেউ বুঝতে পারে না। যেহেতু স্মেল নেই তাই এই সিগারেটটি আমার বেশি পছন্দ।’ একই গ্রুপের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘সুগন্ধি সিগারেটে মেয়েরা আসক্ত বেশি। তার ফেসিনেশন থেকে নিয়ে থাকে। তারা সাধারণ সিগারেটের স্মেল নিতে পারে না।’

তবে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘যারা সিগারেট ছাড়তে চায় তারা সুগন্ধি সিগারেট ঝোকে। তাদের ধারণা, এসব সিগারেটে নিকোটিনও কম। ফলে এই শ্রেণির স্মেলবিহীন সিগারেটে তারা আগ্রহী।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক দোকানি বলেন, ‘বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা সুগন্ধী সিগারেটের বড় ক্রেতা। তবে সব শ্রেণি পেশার মানুষই এসব সিগারেট কিনে থাকেন।’

দুই মাসের অনুসন্ধানে সারাবাংলার এই প্রতিবেদক এমন একজন করপোরেট ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছেন, যিনি প্রায় প্রতিদিনই ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ডের সুগন্ধি সিগারেট সেবন করে থাকেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তাকেও ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ডের সুগন্ধি সিগারেটে আসক্তি বলে দেখা গেছে। তাদেরই একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে সিগারেট ছাড়তে চাইলেও পারছি না। সিগারেট ছাড়ার আগ্রহ থেকে সুগন্ধি সিগারেট নিচ্ছি। মূলত টেস্ট করার জন্য একেকদিন একেক ব্রান্ডের সুগন্ধি সিগারেট টানি।’

অপর একজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চিকন সিগারেটে এখন সবার আগ্রহ বেড়েছে। এগুলোতে নিকোটিন কম থাকে। দামও কম। অর্থ ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের সিগারেট নিই।’ অন্য একজন বলেন, ‘আমি সাধারণত লাইট ও সাদা সিগারেট টেনে থাকি। তবে সবসময় সাধারণ সিগারেট ভালো লাগে না। ফলে মাঝে-মধ্যেই আপেল ও স্ট্রবেরি স্বাদের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট টেস্ট করি।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোটের দফতর সম্পাদক ও ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট্রের কর্মসূচি প্রধান সৈয়দা অনন্যা রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুগন্ধিযুক্ত সিগারেট তামাক কোম্পানির একটি কৌশল। কোম্পানিগুলো তামাক পণ্যে সুগন্ধি ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণদের আসক্ত ও আগ্রহী করে তোলে। এরই মধ্যে সরকার বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সংশোধনী প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সেখানে সিগারেটে যেকোনো ধরণের সুগন্ধি ব্যবহার নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে।’

দেশে নারীদের মধ্যে সিগারেট গ্রহণের হার কম, কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো সুগন্ধি ব্যবহার করে সুকৌশলে নারীদের তামাক সেবনে আকৃষ্ট করছে- এমন অভিযোগ তুলে সৈয়দা অনন্যা রহমান বলেন, ‘দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা কিন্তু সেভাবে ধূমপান করতো না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে কোম্পানিগুলো নানাভাবে তরুণীদের আকৃষ্ট করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্রীদের তারা এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। যাতে তারা ছাত্রীদের গিফট হিসেবে সিগারেট দিয়ে আকৃষ্ট করে। তামাক কোম্পানির মূল টার্গেট তরুণরা।’ সুগন্ধি সিগারেট বন্ধে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটিকে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) কোষাধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘তামাক কোম্পানিগুলো অত্যন্ত ধূর্ত। তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে অল্প বয়সীদের নেশায় আসক্ত করা। কৌশলে তারা তরুণ-তরুণীদের সুগন্ধি সিগারেটেও আকৃষ্ট করছে। তামাক কোম্পানিগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গিফট হিসেবে দেয়- সুদৃশ্য লোগো সম্বলিত লাইটার, গেঞ্জি, কলম ও সিগারেটের বাক্স। এর বাইরে তারা ইনডোর ইভেন্ট করে, কনসার্টও করে- যেগুলো আইনে নিষিদ্ধ।’

তিনি আরও বলেন, ‘ধূমপান কমাতে চাইলে দেশে যে আইনটি আছে, ১৮ বছরের নিচে কারও কাছে সিগারেট বিক্রি করা যাবে না; এই আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের সামনে সিগারেট বিক্রি বন্ধ করতে হবে, হাসপাতালের সামনে সিগারেট বিক্রি বন্ধ করতে হবে। তামাকের বিক্রিয় কেন্দ্রগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে।’

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণ সিগারেটের চেয়ে সুগন্ধি সিগারেট বেশি ক্ষতিকর। সুগন্ধি সিগারেটেও সাধারণ সিগারেটের মতো তামাক থাকে। তামাকের কারণে ফুসফুসের ক্যানসার, মুখমণ্ডলের ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব, হার্ট ডিজিজ, ব্রেইন স্ট্রোক, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদির ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। এরসঙ্গে সিগারেটে ব্যবহৃত সুগন্ধি মুখগহ্বর ও ফুসফুসের অ্যালার্জি, ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। এজন্য মেনথল বাদে অন্যসব সুগন্ধি দ্বারা প্রস্তুতকৃত সিগারেট পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও এটি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুগন্ধি সিগারেটে যে ফ্লেভারিং এজেন্ট দেওয়া হয়, এই এজেন্টটিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সুগন্ধি সিগারেট শ্বাসতন্ত্রের ক্যানসারসহ বেশকিছু ক্যানসারের কারণ। এর নিকোটিন ব্রেইনের সেলগুলোকে প্রথম দিকে উদীপ্ত করে, পরে সেগুলো অবসাদগ্রস্ত হয়ে যায়, আর কাজ করতে পারে না। তারুণ্যের শক্তিই হচ্ছে তার চিন্তা শক্তি। কিন্তু এই সিগারেটের কারণে চিন্তা শক্তি কমে যায়। এটিতে কিছুটা ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে, সেইসঙ্গে মস্তিষ্কের চিন্তা শক্তি কমে যায়। আর সিগারেটের আসক্তি থেকেই মাদকের দিকে চলে যায়। সিগারেটের অসক্তি শেষ পর্যায়ে তরুণদের মাদকের দিকে ঠেলে দেয়।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘পৃথিবীর সব তরুণ-তরুণীরা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। সুগন্ধি সিগারেটের প্রতি তরুণ-তরুণীরা আকৃষ্ট হয় মূলত অ্যাডভেঞ্চারের কারণে। কখনো হয়তো চকলেট ফ্লেভার থাকে, কখনো স্ট্রবেরি। এই ফ্লেভারের কারণে তারা সিগারেটে আকৃষ্ট হয়ে ওঠে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তরুণদের এই আকর্ষণ থেকে রক্ষা করতে হয় ফ্লেভার নিয়ন্ত্রণ করা হয় অথবা নিষিদ্ধ করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আইনের যে সংশোধন চলছে সেখানে সিগারেটে যে কোন ধরণের সুগন্ধি ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে এবং ই-সিগারেটকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই দু’টি প্রস্তাব যদি গৃহীত হয়, কিংবা সরকার যদি এ দু’টি প্রস্তাব গ্রহণ করে; তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কিছুটা হলেও সুরক্ষিত থাকবে।’

আইনজীবী ও নীতিবিশ্লেষক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ‘সুগন্ধী সিগারেট নিয়ে ধূর্ত তামাক কোম্পানি একটি চালাকি করছে। সুগন্ধীর মাধ্যমে নাকি স্তর নির্ধারণ করা হয়। আমরা এই স্তর প্রথার বিরুদ্ধে। এনবিআর বলছে, সুগন্ধি বাদ দিলে স্তর নির্ধারণে ঝামেলা হবে, সরকার রাজস্ব হারাবে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এনবিআর। সুগন্ধি দিয়ে এনবিআর যে স্তর নির্ধারণ করে এটি তামাক কোম্পানির একটি কৌশল। এনবিআরকে এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর্ক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. রুমানা হক বলেন, ‘সিগারেটে সুগন্ধি বা লাইট লেভেলিং করলে ধারণা হয়, এগুলো বোধ হয় স্বাস্থ্যের জন্য কম ঝুঁকি। কিন্তু এটি কখনোই সত্যি নয়। বরং এ ধরণের লেভেলিং তরুণ বা তরুণীদের বেশি আকৃষ্ট করে। তারা মনে করে, এটি অনেক স্মার্ট, এতে খারাপ গন্ধ নেই; গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু এর কোনোটিই সত্য নয়। সুগন্ধি সিগারেট বন্ধে তামাকে আর্টিফিশিয়াল কোনো কিছু ব্যবহার করা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘কর কাঠামোর ক্ষেত্রে লাইট বা সুগন্ধি দিয়ে তারা (এনবিআর) যে কর কাঠামো নির্ধারণ করে, সেখানে বিকল্প পন্থা বের করতে হবে। আমরা চাই, কর কাঠামোতে কোনো স্তর না থাকুক। যতদিন এক স্তরে নেমে না আসছে ততদিন লাইট বা সুগন্ধি বাদ দিয়ে দাম ও অন্যান্য ইনগ্রিডেন্ট বিবেচনা করে স্তর বিন্যাস করা যেতে পারে। ওজন, গুণগত মান ও দামের ওপর নির্ভর করে স্তর বিন্যাস করা যেতে পারে।’

জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আখতারউজ-জামান সারাবাংলাকে বলেন, “সিগারেটের মতো ক্ষতিকর একটি পণ্যের সঙ্গে বিভিন্ন সুগন্ধি সংযোজনের মাধ্যমে তা উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অধিকতর কৌতূহলের উদ্রেক করে, যা তাদের এসব পণ্য ব্যবহারে প্রলুব্ধ করে এবং ক্ষতিকর নেশার পথে ধাবিত করে। তামাকজাত দ্রব্যে নানা আসক্তি ও সুগন্ধিযুক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, যা তামাকজাত পণ্যের ক্ষতিকর প্রভাবকে আরও অনেক বাড়িয়ে তোলে। এ বিষয়টি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’-এর সংশোধনী প্রস্তাবনায় সকল তামাকজাত দ্রব্যের সঙ্গে মিষ্টিদ্রব্য, মশলা, সুগন্ধি (ফ্লেভার), আসক্তিমূলক দ্রব্য, রং ইত্যাদি ব্যবহার নিষিদ্ধ করার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করেছে।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সিগারেটের মূল্যের সঙ্গে স্তরের সম্পর্ক রয়েছে। তবে ফ্লেভারের সঙ্গে স্তরের সম্পর্ক নেই। আর ফ্লেভার ছাড়া কোনো সিগারেট-ই হয় না। প্রতিটি সিগারেটে কিছু না কিছু ফ্লেভার থাকে। সুগন্ধি সিগারেট বন্ধ করলে এনবিআরের আপত্তি নেই। তবে এতে সরকারের অনেক রাজস্ব কমে যাবে।’ এমনটিই ভাষ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তাদের।

তিনি জানান, সিগারেটের চার স্তরের মধ্যে লো স্তরে ৬০ থেকে ৮০ টাকা, মিডিয়াম স্তরে ৮০ থেকে ১২০ টাকা, হাই স্তরে ১২০ থেকে ১৮৫ টাকা ও ১৮৫ থেকে তদুর্ধ্ব ১৮৫ টাকার বেশি। এই চার স্তরেই ৮৩ শতাংশ কর রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘সিগারেটের চোরাচালান বন্ধে কাস্টমস হাউজগুলো কাজ করছে। চোরাচালান বা অবৈধভাবে উৎপাদিত বা আমদানিকৃত সিগারেট বন্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে।’

তবে, তামাকের স্তর নির্ধারণে ফ্লেভার কোনো সমস্যা নয় বলে মন্তব্য করেন এনবিআরের শীর্ষ এক কর্মকর্তা। আইনে সুগন্ধি সিগারেটকে নিষিদ্ধ করলে এনবিআরের কোনো আপত্তি থাকার কথাও নয় বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সিগারেট বা তামাককে দুষ্প্রাপ্য করার চেষ্টা করছি। সিগারেটের ওপর ৮৩ শতাংশ কর ধার্য করা হয়েছে। এটি অনেক উচ্চ কর। বাকি ১৭ শতাংশ দিয়ে সব ব্যয় নির্বাহ করে তাদের মুনাফা করতে হয়। আর অবৈধ সিগারেট বন্ধে ১২ থেকে ১৩ হাজার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আমরা একটি অ্যান্টি টোব্যাকো ক্যাম্পাইনের মধ্যে রয়েছি।’

সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে সুগন্ধি সিগারেট প্রসারে তামাক কোম্পানির অপচেষ্টা প্রতিহত করতে হবে। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রক্রিয়ায় সুগন্ধি সিগারেট নিষিদ্ধের বিধান নিশ্চিতের পাশাপাশি সিগারেটের মূল্যস্তর নির্ধারণে লাইট বা সুগন্ধির বিষয়গুলো বাদ দেয়া জরুরি।

বিজ্ঞাপন

আরো

এমদাদুল হক তুহিন - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর