সিলেট: ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ। সেদিনের সূর্যটা যেন ভিন্ন এক গল্পের সূচনা লিখেছিল। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখার উপজেলার রাজনৈতিক সংঘাতে রক্তাক্ত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সদর ইউনিয়ন ছাত্রদলের তৎকালীন সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী সাজু।
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী এবং তিনবারের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে সংঘাতের জেরে ঘটে যায় ভয়াবহ ঘটনা। তখন বড়লেখার গ্রুপিং রাজনীতির মাঠ ছিল তুঙ্গে। সিরাজ লীগ আর শাহাব উদ্দিন গ্রুপ ছিল মুখোমুখি অবস্থানে। ঠিক সেই সময়ে ছাত্রদল নেতা সাজু চৌধুরীর বাড়ির পাশের রাস্তায় দুর্বৃত্তরা শাহাব উদ্দিনকে হামলা করে মৃত ভেবে ফেলে যায়। সেই হামলার ঘটনায় প্রধান আসামি করা হয় সাজুকে। আওয়ামী লীগের গ্রুপিং রাজনীতির বলি হন সাজু। কয়েক দফা হামলাও হয় তার ওপর। গুরুতর আহত অবস্থায় সীমান্ত পেরিয়ে চলে যেতে হয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে।
একবছর পর ১৯৯৭ সালে দেশে ফিরে তিনি ফের গ্রেফতার হন। ওই সময় তাকে জেলও খাটতে হয়। কিন্তু শান্তি মেলেনি। ২০০২ সালে দেশে ফেরার পর ফের আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের হামলা ও মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে ফের দেশ ছাড়তে হয় তাকে। এর পর কেটে যায় দীর্ঘ ২২ বছর। দেশের মাটি, গ্রামের বাতাস, মায়ের মুখ— সবই রয়ে যায় দূরের স্মৃতি হয়ে।
মা-বাবা চলে গেছেন, প্রিয়জনেরা একে একে হারিয়ে গেছেন, অথচ একবারের জন্যও তাদের কবরের কাছে দাঁড়ানোর সুযোগ পাননি সাজু। অবশেষে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেশে ফেরেন তিনি। কিন্তু ফেরার পরও সহজ হয়নি কিছুই। একসময় যাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, তাদের অনেকেই দূরত্ব বজায় রেখেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকলেও কেউ সাহস করে মন্তব্য করতেন না। অনেকে ভয় পেতেন কেবল ‘সাজু ভাই’-এর পোস্টে লাইক দিতে। তবু তিনি থেমে থাকেননি।

২০১৭ সালে ভারতের শিলংয়ে নির্বাসিত জীবনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে একান্ত মুহূর্তে শাহজাহান চৌধুরী সাজু। ছবি: সংগৃহীত
নিজের মাটি, নিজের দল, নিজের মানুষের প্রতি ভালোবাসাই তাকে টেনে এনেছে রাজনীতির মাঠে। তৃণমূলের ভোটে তিন মাস আগে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন বড়লেখা সদর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হিসেবে। সারাবাংলার প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাসিত বিএনপি নেতা শাহজাহান চৌধুরী সাজু বলেন, ‘বিগত সময়ে দেশে ফিরলেও আওয়ামী লীগ সরকারের হামলা, মামলা, গুম-নির্যাতনের ভয়াবহ স্মৃতি এখনো চোখে জল এনে দেয়। নির্বাসিত জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্ট— আমি আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে পারিনি। তাদের কবরে এক মুঠো মাটি দিতে পারিনি। এই আক্ষেপ বয়ে বেড়াব সারাজীবন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিএনপির রাজনীতি করি, দেশ স্বাধীন— তাই বাড়িতে ফিরে স্থানীয় রাজনীতির মাঠে তৃণমূলের সঙ্গে কাজ করছি। দল আমাকে কী দিয়েছে বা দেয়নি, সেটা বড় বিষয় নয়। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভালোবাসা ও সম্মান। এ ভালোবাসাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ, যা নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই।’
আক্ষেপের ছাপ চোখে থাকলেও কণ্ঠে দৃঢ়তা। সাজু আরও বলেন, ‘আমি জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। আমি জিয়াউর রহমানের আদর্শে বিশ্বাস করি। আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করি। তাই এত কিছু সহ্য করেও বিএনপির রাজনীতি করছি।’
বঞ্চনা, রক্ত, নির্বাসন— সবকিছুর মাঝেও শাহজাহান চৌধুরী সাজু আজও বিশ্বাস করেন, রাজনীতি মানে ক্ষমতা নয়, ত্যাগ।