সাতক্ষীরা: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে এক সময়ে নদীর বুকে ছিলো ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস, ছিল জীবনের স্রোতধারা। আজ সেই নদীগুলো নিঃশব্দে মরছে। ভরাট খাল, দখলকৃত চর আর স্থাপনার নিচে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের জলজ ঐতিহ্য। খুলনা বিভাগে অপরিকল্পিত উন্নয়ন গলাটিপে হত্যা করছে জলরাশিকে।
শাসনের ফলে মরতে বসেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জনপদ সাতক্ষীরার ছোট-বড় ২৭টি নদ-নদী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেহাল দশা বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর। নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও জোয়ার-ভাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাতক্ষীরার অধিকাংশ নদী তার গতিপ্রকৃতি হারিয়ে ফেলেছে। কপোতাক্ষ, বেতনা, কাকশিয়ালী, মরিচ্চাপ, যমুনা, সোনাই, বলুয়া, গলঘেষিয়া, গুতিয়াখালী, সাপমারাসহ অধিকাংশ নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে।
জেলার পাইকগাছার শিবসা নদীর বুক এখন শুকনো মাটির চওড়া প্রান্তর। কোথাও কোথাও ভাঙাচোরা নৌকার খোলস পড়ে আছে স্মৃতিচিহ্ন হয়ে। দু’পাশে পলি জমে নদীটি হারিয়েছে প্রবাহ, হারিয়েছে যৌবন। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে পুরো অঞ্চলের জীবনযাত্রা।
নদী গবেষকদের মতে, বিভিন্ন নদী অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া, বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রবাহ আটকে দেয়া, উজান থেকে পানির প্রবাহ না আসা এবং ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যেই খুলনা বিভাগের পাঁচটি নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। মরে গেছে আরো চারটি নদী। শুকিয়ে যাচ্ছে একটির পর একটি নদী ও শাখা নদী। আর এর প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর।
সম্প্রতি এই এপ্রিলেই নদ-নদী বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) তাদের গবেষণায় বলেছে, দেশে অন্তত ৮১টি নদী পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে বা চরম সংকটাপন্ন হয়ে শুকিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকারি তথ্য, বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও সাময়িকী এবং সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে তথ্য নিয়ে ‘ড্রাইড-আপ রিভার্স অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আরডিআরসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের নদীগুলো ‘বিপজ্জনকভাবে’ বাস্তুসংস্থানজনিত সংকটের মুখে আছে। তার ফলে নদীকেন্দ্রিক বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলে মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষি ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ‘হুমকির’ মধ্যে পড়েছে।
আরডিআরসির এই প্রতিবেদন অনুসারে, খুলনা, সাতক্ষীরা, রাজশাহী ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য হারে নদ-নদী সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছেছে।
এর কারণ হিসেবে প্রকট দূষণ, পলি, কাদা, নুড়িপাথর, বালু জমে যাওয়া, দ্রুত নগরায়ণ এবং অববাহিকার সঙ্গে সংযোগ হারানোর কারণে প্রাকৃতিকভাবে নদীপ্রবাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার কথাই ঘুরে-ফিরে এসেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ওই ৮১টি নদীর মধ্যে খুলনা বিভাগে সর্বাধিক ২৫টি নদ-নদী রয়েছে। এরপর রয়েছে রাজশাহীতে, ২০টি। এছাড়া রংপুরে ১৫টি, চট্টগ্রামে ৬টি, ময়মনসিংহে ৫টি, ঢাকায় ৪টি, বরিশালে ৩টি এবং সিলেটে ৩টি নদী রয়েছে। এগুলোর বাইরে কিছু নদী সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
কেন নৌপথ গুরুত্বপূর্ণ?
পাইকগাছা বাজারের ব্যবসায়ী তপন ঘোষ বলেন, এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় সব পণ্য এক সময় নদী পথে সরবরাহ করা হতো। শিবসা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছর নৌপথে পণ্য আনা-নেয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। কারণ, নৌপথে পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে খরচ ও ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়। এক বছর আগে এই নদীতে বড় বড় জাহাজ আসতো কিন্তু বছরের ব্যবধানে সেই নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। পুরো নদী ভরাট হয়ে গেছে। চর পড়ে মানুষ সেখানে ফসল লাগানোর পায়তারা করছে। কেউ কেউ স্থাপনা করছে।
কপিলমুনি বাজারের মিলন বাবু বলেন, ‘নদী পথে মালামাল কম খরচে আনা যেত। কিন্তু এখন আমাদের দিগুণ খরচে স্থল পথে মালামাল নিয়ে আসতে হচ্ছে৷ একদিকে নদী পথে রিস্ক কম, আবার কম খরচে মালামাল আনা নেওয়া করা যায়। কিন্তু এখন সেই উপায়েও ভাটা।’
স্থানীয় বাসিন্দা প্রভাষ ঘোষ বলেন, ‘আগে আমাদের নদীতে আগে বড় বড় জাহাজে মালামাল আনা নেওয়া করা হতো। কিন্তু নদী ড্রেজিং না করায় দিন দিন নদীর নাব্য হারিয়ে যাচ্ছে। হয়ে যাচ্ছে পানি শূন্য আর ড্রেজিং না হওয়ায় নদী হারিয়েছে নাব্য। শেষ হয়ে বসেছে নদীর চিরচেনা যৌবন।’ ফলে এলাকার মানুষ দখল করে কৃষি জমিতে রুপান্তরিত করে ফেলেছে নদীটিকে।
মৃণাল রায় বলেন, ‘এক সময় এই নদী যৌবনে ভরপুর ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা আর নেই। দীর্ঘদিন থেকে ড্রেজিং না করায় নদী তার গতিপথ হারিয়ে ফেলেছে।’
স্বপ্না মল্লিক বলেন, ‘এক সময় এই নদী পাইকগাছা, কয়রা, সাতক্ষীরা যাওয়া আসা, বেচাকেনার প্রধান নো রুট ছিল। চলাচল করতো বড় বড় নৌকা। আমরাও নদীতে গিয়ে মাছ ধরেছি। কিন্তু এখন আর তা চোখে পড়ে না।’
দখল-দূষণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়নে নাব্য হারাচ্ছে নদী
নদী দখল এবং দূষণ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে ফলে অস্তিত্বকে হুমকির মুখে পড়ছে দিন দিন। বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে নদীর চিরচেনা রূপ। যৌবন হারিয়ে পরিণত হচ্ছে মরা খালে। তাছাড়া, নদী দখল করে গড়ে উঠছে অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দখল হয়ে যাচ্ছে নদীর পাশে জেগে ওঠা চর গুলো। এদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং হিমবাহ গলার কারণে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে নদী তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীগুলোর সাথে তাদের প্রাণভোমরা মূল নদীর সংযোগ ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নদীকে গলাটিপে মারছে। নদী মরে যাওয়ার কারণে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট দেখা দিয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে। শুষ্ক মৌসুমেই যেন নদীর মড়ক লাগে। আর এই মরা নদীর সাথে হারিয়ে যাচ্ছে এক একটি ইতিহাস। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অনেক স্মৃতি সাহিত্য-ঐতিহ্য, লোক কাহিনী ও জীবনের গল্প।