রংপুর: রংপুরে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর গোপন নাশকতার পরিকল্পনায় স্থানীয় মানুষের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচির আড়ালে এই সংগঠনগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক পোস্ট, রাতের আঁধারে গোপন সভা এবং মশাল মিছিলের মতো ঘটনা ঘটিয়ে জনজীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আগামী ১৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে এনসিপি, বিএনপি, জামায়াত এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লক্ষ্য করে নাশকতার জাল বোনা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের তৎপরতায় গত ২৪ ঘণ্টায় মহানগর ও জেলা থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অন্তত ৬ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সেনাবাহিনী মাঠে থাকার আশ্বাস দিলেও, জনমনে ভীতি ও দুশ্চিন্তা কাটছে না।
তারা বলেন, ‘‘রংপুরের বাজার ও পাড়া-মহল্লায় রাতের অন্ধকারে গোপন সভা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ঢাকা অচল’ ও ‘ইউনূস সরকার উৎখাত’ এসব উসকানি দেখে মানুষের ঘুমচোখে উদ্বেগ।’’
নগরির হাজিরহাটের এক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আব্দুল করিম বলেন, ‘রাতে মশাল মিছিল দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেছে। আমরা তো শুধু শান্তিতে ব্যবসা চালাতে চাই, কিন্তু এসব নাশকতার গন্ধ পেলেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাই।’
অভিযোগ রয়েছে দিনাজপুর, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জেলা উপজেলার কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতারা ‘লগি বৈঠা হাতে ধরো, ঢাকাকে অচল করো’ মতো পোস্ট করে জনমনে ভীতি সৃষ্টি করছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সমর্থিত সূত্র বলছে, রংপুর অঞ্চলের ৭০ শতাংশ বাসিন্দা ১৩ নভেম্বরকে ‘আতঙ্কের দিন’ হিসেবে দেখছেন।
স্থানীয়রা অভিয়োগ করেন, নিষিদ্ধ দলটি ১৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে এনসিপি, বিএনপি, জামায়াত এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লক্ষ্য করে নাশকতার জাল বুনছিল। গত রোববার রাতে রংপুর সিটি করপোরেশনের হাজিরহাটে জেলা যুবলীগ সভাপতি লক্ষীন চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে মশাল মিছিল বের হয়, যেখানে নেতা-কর্মীরা ‘ঢাকা অচল’ ঘোষণা দিয়ে হুমকি সওয়ার করে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি এসএম সাব্বিরের ফেসবুক পোস্টে। তিনি লিখেছেন, ‘অবৈধ ঘুসখোর মাফিয়া ইউনূস সরকারকে বিদায় দিতে হবে।’ যুবলীগ সভাপতি লক্ষীন চন্দ্র দাস পোস্টে লিখেছেন ‘শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করতে ঢাকা অচল কর।’
অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, রংপুরের উপজেলাগুলোয় প্রতি রাতে গোপন সভায় কৃষক লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মী অংশ নিচ্ছেন। এসব সভায় দিনাজপুর যুবলীগ, গাইবান্ধা স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং সাবেক এমপি ইকবালুর রহিমের সমর্থক গোষ্ঠীও এতে জড়িত। এ ছাড়া, দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে তারা।
তবে রংপুরে পুলিশসহ নিরাপত্তায় সংশ্লিষ্টরা তাদের কাজে তৎপর রয়েছেন। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলীর নির্দেশে অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে কোতোয়ালি থানা থেকে মহানগর আওয়ামী লীগ ১৪ নম্বর ওয়ার্ড সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম (বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদুল ইসলাম সাগর হত্যাচেষ্টার আসামি), ৬ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি শফিকুল ইসলাম মোকাররম, কল্যাণী ইউনিয়ন যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক জালাল উদ্দিন; তাজহাট থানা থেকে ১৫ নম্বর ওয়ার্ড সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক রায়হান আলী। মিঠাপুকুর থানা থেকে ৬ নম্বর কাফ্রিখাল ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি ফুয়াদ মন্ডল (স্থানীয়দের গণপিটুনির পর গ্রেফতার), বদরগঞ্জ থেকে দামোদারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আজিজুল হক (সন্ত্রাস দমন আইন মামলায়)। পীরগাছায় ‘লকডাউন’ প্রচারণায় যুবলীগ নেতা আমজাদ হোসেন (৫০) আটক করা হয়। সোমবার সন্ধ্যায় মেট্রোপলিটন ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি মনজুরুল হক মানিক (২৮) গ্রেফতার করা হয়, যার বিরুদ্ধে গুলিবিদ্ধ মকবুল হোসেন হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার আবু সাইম ও মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আব্দুল মজিদ বলেন, ‘যেকোনো নাশকতা বাধাগ্রস্ত করতে পুলিশ তৎপর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশবিরোধী পোস্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, কর্মসূচি ঘিরে কোনো আশঙ্কা নেই, সেনাবাহিনী মাঠে রয়েছে। এমন আশ্বাসের পরও যেন স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন না নগরবাসী।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বেলাল বলেন, ‘বিএনপি প্রার্থীদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট প্রার্থনা করায় নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতাকর্মীরা ঘুরে বেড়ানোর সাহস পাচ্ছে। এখানে যদি প্রশাসনকে বিএনপি নেতাকর্মীরা সহযোগিতা করত তাহলে আজকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো ধরনের উসকানিমূলক কথাবার্তা পোস্ট করার সাহস পেত না।
তবে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ চোরাগুপ্ত অপকর্মে লিপ্ত, কিন্তু আমরা প্রশাসনের সহায়তায় তাদের ধরিয়ে দেব।’