Wednesday 12 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছেঁড়া টাকা নিয়ে বিপত্তি, ব্যাংক পাড়ায় টাকার হাট, বেচাকেনা হয় দেশি-বিদেশি মুদ্রা

আদিল খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১২ নভেম্বর ২০২৫ ১৯:১৬ | আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৫ ২০:১৪

-ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা: নতুন টাকার ক্ষেত্রে জাল নোটের আতঙ্ক থাকলেও গ্রাহকের সামনে বড় বিপত্তি হিসাবে আবির্ভাব হয়েছে ছেঁড়া-ফাটা নোট। এ ধরনের নোটকে কেন্দ্র করে অহরহ ঘটছে গালমন্দ, কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা। বিশেষত ১০ টাকার নোটের বারবার হাত বদলানোর ঘুরপাকে দ্রুত নষ্ট হয়। ফলে ১০ টাকার ছেঁড়া-ফাটা নোট লেনদেনে বিপত্তির পারদ ঘনঘন ওঠা-নামা করছে।

সর্বশেষ গত কোরবানির ঈদের আগের সীমিত পর্যায়ে ২০ টাকা, ৫০ টাকা এবং ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট বাজারে ছেড়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যা নিয়ে ওই সময় কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। নতুন নোটের সরবরাহ কম হওয়ায় কালে-ভদ্রে দেখা পাওয়া যায় ‘সোনার হরিণ’ খ্যাত নতুন টাকার।

বিজ্ঞাপন

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, টাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি থাকায় কয়েকটি পক্ষ থেকে আপত্তি উঠেছে। নতুন নকশার নোট বাজারে ছাড়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের কাছে প্রচুর মজুত টাকা রয়েছে। কিন্তু টাকার নকশায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি থাকায় সেগুলো বাজারে ছাড়া যাচ্ছে না। আবার নতুন টাকার নকশা নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর মতিঝিলে মেট্রোরেলের নিচে, গুলিস্তান পাতাল মার্কেট এলাকায় ছোট টেবিল ও টুল নিয়ে অর্ধশত ‘টাকার হাটে’ বেচাকেনা হচ্ছে দেশি-বিদেশি টাকা। সেখানে ছেঁড়া টাকা কমদামে কিনছেন টাকা ব্যবসায়ীরা। আর প্রচলিত সচল নতুন টাকা গায়ের দরের চেয়ে চড়া দরে টাকা বিক্রি হচ্ছে। ১০ টাকা মূল্যমানের ১০০টি নতুন নোটের ১ হাজার টাকার বিপরীতে গুনতে হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকা। ২০ টাকা নোটের ২ হাজার টাকার বান্ডিল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। ৫০ টাকার বান্ডিলের ৫ হাজার টাকার জন্য গুনতে হচ্ছে ৫ হাজার ১৫০ টাকা।

সেনা কল্যাণ ভবনের সামনে যাত্রাবাড়ী থেকে আসা রূপালী বেগম বলেন, আমার টাকা কিছুটা ইঁদুর কেটেছে। যা নিয়ে যাত্রাবাড়ীর কয়েকটি ব্যাংকের শাখায় গেলে নানা অজুহাতে সেই টাকা নেয় নি কাউন্টারের দায়িত্বরত ব্যাংক কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তারা ভেংচি কেটে অশোভন আচরণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগ গ্রহণের ১৬২৩৬ হটলাইন নম্বর কল দিয়েও প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হয়নি। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে নির্ধারিত কাউন্টারের সারিতে দীর্ঘ অপেক্ষা করে ছেঁড়া টাকা জমা দিলে কাউন্টারম্যান জানান, তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া টাকা দিতে পারবেন না। এমনও হতে পারে এক টাকাও ফেরত পাবেন না। পর‌ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি বুঝে নিরূপায় হয়ে মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকায় ৫ হাজার টাকার নোটগুলো বিক্রি করি।

পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী নুরুল হাসিব জানান, জাল টাকা নিয়ে প্রতারণার চেয়ে ছেঁড়া-ফাটা টাকা নিয়ে আতঙ্ক ঢের বেশি। ছেঁড়া টাকা নিয়ে একের পর এক বিপত্তি দেখা যায়। বিভিন্ন খরিদদার আসেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ লেনদেনের সময় কৌশলে ছেঁড়া-ফাটা নোট দেন। বেচাকেনার ব্যস্ত সময়ে সব নোট একটা একটা করে যাচাই করাটা শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব বলা চলে। আবার কেউ কেউ স্থানীয় ও রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ছেঁড়া-ফাটা অচল টাকা নিতে হুমকি দেন, বাধ্যও করেন। এদিকে ক্রেতাদের ছেঁড়া বা অচল টাকা ব্যাংকে জমা দিতে গেলে ব্যাংকও নানা অজুহাতে নিতে চায় না। বরং জ্ঞান দেয় যেন টাকা দেখে নেন না কেন? এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে টাকার হাটে বিক্রি করা হয় ছেঁড়া-ফাটা নোট।

রাজধানীর পল্টন মোড় এলাকায় এক রিকশাওয়ালা ও যাত্রীর মধ্যে ছেঁড়া টাকা নিয়ে মারামারি হয় গত বৃহস্পতিবার। রিকশাওয়ালা ছেঁড়া টাকা না নেওয়ায় তাকে মারধর করেন দুই যাত্রী। পরে উৎসুক জনতার মধ্যস্থতায় রিকশাওয়ালা ক্ষতিপূরণ বাবদ যাত্রীর জরিমানা করা হয় ৩০০ টাকা। অথচ মাত্র ৫টি ১০ টাকার ছেঁড়া ও পোড়া ছিল। এ ক’টা টাকা নিয়ে রক্তাক্ত হন সেই রিকশাচালক। উত্তেজিত জনতাও দুই যাত্রীর গায়ে চড় থাপ্পড় দেয়। ছেঁড়া টাকার মত তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র কত বড় বিপত্তি ঘটে তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই কারো।

গত ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক ছেঁড়া, পোড়া বা বিভিন্ন কারণে নষ্ট হওয়া প্রচলিত টাকার নোটের বিনিময়মূল্য ফেরত দেওয়ার বিষয়ে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ নীতিমালার আওতায় গ্রাহকেরা ব্যাংক থেকে নষ্ট হওয়া নোটের বিনিময়মূল্য ফেরত পাবেন। কোনো নোটের ৯০ শতাংশের বেশি বিদ্যমান থাকলে ওই নোটের বিপরীতে গ্রাহক মূল্যমানের পুরো অর্থ ফেরত পাবেন। ক্ষতিগ্রস্ত নোটের ৭৫ শতাংশের বেশি থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত থাকলে নোটের মূল্যমানের ৭৫ শতাংশ অর্থ ফেরত পাবেন। নষ্ট নোটের ৫১ শতাংশের বেশি থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত থাকলে মূল্যমানের ৫০ শতাংশ অর্থ ফেরত পাবেন। কোনো নোটের ৫১ শতাংশের কম থাকলে ওই নোটের বিপরীতে গ্রাহক কোনো অর্থ পাবেন না।

শুভ নামে এক লোক বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের একটি দোকান থেকে থাইল্যান্ড, সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কয়েন ও নোট কেনেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

তবে দোকানদার জানান, অনেকে শখ করে বিদেশি কয়েন ও মুদ্রা কেনেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, সরকারি নির্দেশনার কারণে নতুন টাকা বাজারে ছাড়া বন্ধ আছে। বাজারে যেসব টাকা দেখা যাচ্ছে, সেগুলো আগে থেকেই হয়তো তারা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। পুরোনো টাকা বিনিময়ে বাধ্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। অবৈধ টাকার ব্যবসার লেনদেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও পুলিশের সহায়তা দরকার। ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বন্ধ করবে। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরে আমাদের কিছু করার নেই। আর ওই সব বিক্রেতার টাকার উৎস কোথায়, কারা দেয়, তা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। কারও সংশ্লিষ্টতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সারাবাংলা/এসএ/এসআর
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর