ঢাকা: জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থতিতে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচন। সেই ধারাবাহিকতায় আসছে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর এবারই প্রথম হতে যাচ্ছে জকসু নির্বাচন। সে লক্ষ্যে এরই মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়ন ফরম বিক্রিও শুরু হয়েছে। আর এর পর থেকেই নির্বাচন ঘিরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনৈতিক জোট ও পদবণ্টনের হিসাব-নিকাশ।
জানা গেছে, নির্বাচনের সময় নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও ক্রিয়াশীল মোটামুটি সব ছাত্রসংগঠন নির্বাচনে অংশ নেবে। এদের মধ্যে কেউ সরাসরি ব্যানারে, কেউ জোটবদ্ধ ব্যানারে, কেউ আবার স্বতন্ত্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তবে তফসিল ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের বৃহৎ ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের সম্ভাব্য প্যানেলকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক। কারণ, চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের ফলাফলের পর এবার আর তারা এককভাবে নির্বাচন করতে চাইছে না। জবিতে তারা জোটবদ্ধ বা যৌথ প্যানেলে ভোট করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে ভিপি-জিএসসহ প্রায় অর্ধেক পদ অন্যদের ছেড়ে দেওয়া লাগতে পারে। আর এতেই ক্যাম্পাসের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
ছাত্রদলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন রাজনীতিতে সক্রিয় কর্মী বাদ দিয়ে বাইরের প্রার্থী এনে প্যানেল সাজানো হচ্ছে। এটি জবি ছাত্রদলের একক শক্তিকে ধ্বংস করার চেষ্টা। এই সিদ্ধান্তে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের চাপ রয়েছে বলেও অভিযোগ করছেন তারা। এতে তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রদল জকসু নির্বাচনে যে প্যানেল ঘোষণা করতে যাচ্ছে, সেখানে ভিপি-জিএস, সম্পাদক ও সদস্য মিলে ১০টি পদই ছাত্রদলের বাইরের প্রার্থী দিয়ে পূরণ হতে পারে। এর মধ্যে ছাত্র অধিকার পরিষদ ও অন্যান্য সংগঠনের কয়েকজন নেতাকে এই প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। এতে করে ছাত্রদলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা অবমূল্যায়িত হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। নেতাকর্মীরা বলছেন, বহু বছর ধরে সংগঠনের পতাকা বহন করে আন্দোলন করেছি, নির্যাতন সহ্য করেছি। অথচ এখন বাইরের মানুষ এসে নেতৃত্বের আসনে বসবে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
সূত্রমতে, ছাত্রদল তাদের প্যানেলের ২১টি পদের মধ্যে ১০টি পদ বাইরের সংগঠন বা অরাজনৈতিক প্রার্থীদের দিতে প্রস্তুত। এর মধ্যে ছাত্র অধিকার পরিষদের কাছে যেতে পারে ভিপিসহ ছয়টি পদ। এখানে ভিপি পদে ছাত্র অধিকার পরিষদ জবি শাখার সভাপতি একেএম রাকিব, জিএস পদে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও খাদিজাতুল কুবরাকে, যিনি আওয়ামী লীগের সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাভোগ করেছিলেন। এজিএস পদে ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আতিকুর রহমান তানজিলের নাম ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
ছাত্রদলের একাধিক নেতাকর্মী এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এমন হলে শীর্ষ তিন পদের মধ্যে এক এজিএস ছাড়া ভিপি ও জিএস শীর্ষ দুই পদেই ছাত্রদলের বাইরের প্রার্থী থাকবেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জবি ছাত্রদলের এক যুগ্ম আহবায়ক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রদল সবসময় জবিতে শক্ত অবস্থানে ছিল। এখন যদি বাইরের প্রার্থীদের দিয়ে প্যানেল গঠন হয়, তাহলে আমাদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের দাম শূন্যে নেমে আসবে। আমরা চাই, জবি ছাত্রদলের নিজস্ব প্রার্থীরাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক।’
এ নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রদলের একাধিক নেতা সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ছাত্রদল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ছাত্রসংগঠন। এর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান— সব জায়গায় জবি ছাত্রদল ছিল সামনের কাতারে। এখন যখন জকসু নির্বাচন সামনে, তখনই বহিরাগতদের প্রাধান্য দিয়ে আমাদের উপেক্ষা করা হচ্ছে। এটি একটি মহলের ষড়যন্ত্র, যারা জবি ছাত্রদলের ঐক্য ও নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে চায়।’
তারা আরও বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের সংগঠনের যোগ্য, মেধাবী ও ত্যাগী নেতারাই প্রার্থী হোক। বাইরের সংগঠনের নেতাদের এনে প্যানেল সাজানো মানে হচ্ছে ছাত্রদলকে দুর্বল করা। ভাড়াটে প্রার্থী দিয়ে কখনো ছাত্ররাজনীতি টেকে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের যে ঐতিহ্য আছে, তা কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।’
প্যানেল নিয়ে জানতে চাইলে জবি ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাখাওতুল ইসলাম পরাগ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না যেখানে বিগত সরকারের সময়ে নির্যাতনের শিকার কোনো ত্যাগী কর্মী তার প্রাপ্য জায়গা থেকে বঞ্চিত হয়। আমাদের অভিভাবক দেশনায়ক তারেক রহমানের কাছে অনুরোধ, তিনি যেন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের যোগ্যতাকেই অগ্রাধিকার দেন। আমি সবসময় দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তবে এমন সিদ্ধান্ত যেন না হয় যা আমাদের কর্মীদের হতাশ করে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জবি ছাত্রদলের সদস্য সচিব সামসুল আরেফিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবকিছু বিবেচনায় আমরা একটা ইনক্লুসিভ প্যানেল দেওয়ার চেষ্টা করছি। আশা করি ভালো কিছু হবে।’ ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অসন্তোষের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে সবাই তো নিজেকে মনে মনে ভিপি মনে করেন। এতে আবার অনেক মিডিয়া হাইপও তুলে দেয়। কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন।’