Friday 14 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সবকিছু নিয়ে হাজির হলেন ব্রাজিলের সেই ট্যাক্সিচালক !

উজ্জল জিসান স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৪ নভেম্বর ২০২৫ ২১:১১ | আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৫ ২২:১৮

সাওপাওলো, ব্রাজিল থেকে: সাওপাওলোর গুয়ারোহোস বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে ব্রেইজ। স্থানটি বাংলাদেশি পাড়া হিসেবে পরিচিত। পুরান ঢাকার মতোই ঘিঞ্জি ব্যবসায়িক এলাকা, যেখানে দিনের শুরু হয় রাত ১২টায়। গভীর রাতেই বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা এসে জমায়েত হন। বেচাকেনা চলে টানা দুপুর পর্যন্ত, তারপর যেন এলাকা জুড়ে নেমে আসে নীরবতা। ব্রেইজের এই ব্যস্ততা শুধু ব্রাজিলেই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও পণ্য সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

ঠিক সেই ব্রেইজ এলাকা থেকেই বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) রাতে একটি উবার ট্যাক্সি ধরে আমি যাচ্ছিলাম গুয়ারোহোসের হোটেল স্লিপ-ইনে। দীর্ঘদিনের ক্লান্তি, লাগেজের ঝামেলা—সব মিলিয়ে হোটেলে পৌঁছে দোরগোড়ায় পা রাখতেই মনে হলো, কিছু একটা নেই। মুহূর্তের মধ্যেই বুক কেঁপে উঠল—ওয়ালেট!

বিজ্ঞাপন

ডলার, রিয়াল, ডেবিট–ক্রেডিট কার্ড, আইডি—সব ছিল সেই ওয়ালেটে। বুঝলাম, উবার থেকে নামার সময়ই সেটি পিছনের আসনে ফেলে এসেছি। নিচে দৌড়ে গেলাম, কিন্তু ট্যাক্সিটি তখন আর দৃশ্যমান নয়। একটা নির্জন রাত, বিদেশ বিভুঁই, আর আমার হাতে নেই পরিচয় ও অর্থের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও।

এরপর ব্রাজিলে দীর্ঘদিনের পরিচিত বাংলাদেশি চাঁদপুরের হারুন ভাই, উবার অ্যাপ থেকে চালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। ফোন ধরল না। এদিকে, বেলেম যাওয়ার জন্য যে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট টিকিট কাটা হয়েছিল, সেই টিকিট দিতে মৌলভীবাজারের জাবেদ ভাই হোটেলে এলেন। তিনিও শুনে মাথা নাড়লেন— বললেন উবার চালক ‘আসতেও পারে, আবার নাও আসতে পারে।’

একসময়ে সবাই পরামর্শ দিতে লাগলেন—উবারে অভিযোগ দাও, ক্লেইম করো। কিন্তু সেটাও নাকি অনেক ক্ষেত্রে কাজ করে না। মনের মধ্যে তখন একটাই ভয়—‘সে যদি বলে দেয়, তার গাড়িতে কিছুই পড়েনি?’

হতাশা যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তখনই হঠাৎ হোটেলের সামনে একটি গাড়ি থামল। চমকে উঠে জানালা দিয়ে তাকাতেই-বুঝলাম—সেই উবার!

দৌড়ে গিয়ে দেখলাম, গাড়ি থেকে নেমে আসছেন একেবারে সাদা চামড়ার সাদা টি–শার্ট পরা প্রায় ত্রিশ বছরের এক যুবক। মুখে অল্প হাসি। হাতে আমার ওয়ালেট। কোনো নাটক নয়, কোনো ব্যাখ্যা নয়—শুধু আন্তরিক এক ভঙ্গি।

আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। হাত চেপে ধরলাম। ভাষা হারিয়ে ফেললাম আবেগে। বারবার বলতে লাগলাম—“থ্যাংক ইউ… থ্যাংক ইউ…”

রিয়াল বের করে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইলে তিনি মাথা নাড়িয়ে শুধু বললেন—“ইট’স ওকে… ইট’স ওকে।”

আমার সঙ্গে থাকা সবাই বলে উঠলেন—“ছেলেটা সত্যিই ভালো ছিল।”

কারণ ব্রাজিল সম্পর্কে সবারই ধারণা—এখানে টাকার প্রতি মানুষের টান প্রবল। কিন্তু সেই ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে, সে সবকিছু নিয়ে ফিরে এসেছে।

আবেগে ছবি তোলার কথাও মাথায় আসেনি কারও। শুধু দাঁড়িয়ে থাকলাম বিস্ময়ে—মানুষের সততার এমন উদাহরণ আজকাল কোথায় দেখা যায়?

এমন ঘটনা এর আগেও ঘটেছে—বাংলাদেশ থেকে আসা সিনিয়র সাংবাদিক সাইদ ভাইও একবার ট্যাক্সি থেকে নেমে লাগেজ ফেলে গিয়েছিলেন। সেদিনও এক ট্যাক্সিচালক ফেলে যাওয়া লাগেজ হাতে হোটেলে ফিরে এসেছিলেন।

দীর্ঘদিন ধরে ব্রাজিলে থাকা নোয়াখালীর সাইফুল ভাই কথাটা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করলেন—“এদেশে সবাই ভালো। দুয়েকজন ছাড়া। আর বাংলাদেশে তার উল্টোটা—দুয়েজন ভালো, বেশিরভাগই খারাপ। আপনার ওয়ালেট হাতে পেয়েও সে হাত দেয়নি। বাংলাদেশে হলে সব হাওয়া হয়ে যেতো।”

সেই রাতে ব্রাজিলের এক অপরিচিত ট্যাক্সিচালক শুধু আমার হারানো জিনিস ফেরত দেননি—ফেরত দিয়েছেন মানুষের প্রতি বিশ্বাসও।

বিজ্ঞাপন

আরো

উজ্জল জিসান - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর