Friday 14 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংলাপ চললেও সুফল নেই, ২ পরাশক্তির দ্বন্দ্বে ইউক্রেন পরিস্থিতি জটিল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১৪ নভেম্বর ২০২৫ ২৩:৫৭

ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করেছিলেন ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করে ‘ভ্লাদিমিরের সঙ্গে শান্তি স্থাপন’ করার স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু তার দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর দিকে মস্কো এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে সরাসরি আলোচনা শুরু হওয়ার আংশিক ইতিবাচক ইঙ্গিত মিললেও, পরিস্থিতি এখন নাটকীয়ভাবে বিপরীত। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনা দ্রুত বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তেল কোম্পানিগুলোর ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, অন্যদিকে ক্রেমলিন পরীক্ষা চালিয়েছে তাদের নতুন পারমাণবিক সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন।

আলোচনার টেবিলে বসার সামান্য অগ্রগতি সত্ত্বেও, যুদ্ধ এখনো অব্যহত রয়েছে এবং দুই দেশ শান্তি প্রস্তাবের বদলে সামরিক শক্তির প্রদর্শন ও হুমকির পথে হাঁটছে। ‘ভালো কথা হয়, কিন্তু কিছুই এগোয় না’—ট্রাম্পের এই হতাশার বাক্যটিই বর্তমান অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

বিজ্ঞাপন

অগ্রগতির ইঙ্গিত পেলেও স্থবির

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর দিকে (রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আক্রমণের পর) মস্কো এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে প্রথম সরাসরি আলোচনা শুরু হওয়ায় কিছুটা অগ্রগতির আংশিক ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। দুই প্রেসিডেন্ট নিয়মিত ফোনে কথা বলেছেন এবং গত আগস্ট মাসে আলাস্কায় বৈঠকও করেছেন। তবে, বর্তমানে, উভয় পক্ষের একমাত্র সাফল্য হলো যে সংলাপ অন্তত বজায় আছে।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের ইউরোপ ও রাশিয়াবিষয়ক সাবেক সিনিয়র ডিরেক্টর অ্যান্ড্রু পিক বলছেন, ‘আমরা অন্তত শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলছি, এটাই বড় অগ্রগতি। নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরা এবং মত বিনিময় করাই হলো কূটনীতির ভিত্তি ‘

ব্যক্তিগত সম্পর্কে ট্রাম্পের ভরসা, কূটনীতিতে অচলাবস্থা

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপরই বেশি ভরসা করেছিলেন। তিনি তার পুরনো নিউ ইয়র্কের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়িক বন্ধু স্টিভ উইটকফকে বিশেষ দূত হিসেবে পুতিনের সঙ্গে দেখা করার জন্য বেশ কয়েকবার পাঠিয়েছিলেন। প্রতিটি সফরের পর উভয় পক্ষই জানায় যে তারা সমঝোতার কাছাকাছি চলে এসেছেন।

কিন্তু পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে যারা কাজ করেন, সেসব মহলে উইটকফের কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘সন্দেহ’ রয়েছে।

ইউরোপের দুইজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কূটনীতিক বিবিসিকে জানান, উইটকফ প্রায়ই পুতিন ছাড় দেবেন—এমন ভুল ধারণা নিয়ে মস্কো যেতেন। কিন্তু পরে হোয়াইট হাউস দেখতো যে বাস্তবতা তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

রাশিয়ার একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ‘উইটকফ রাশিয়ার অবস্থানের সূক্ষ্মতা বুঝতে পারতেন না এবং ক্রেমলিনকে মার্কিন নীতি ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও অসংগতিপূর্ণ ছিলেন। ফলে উভয় পক্ষই প্রায়ই বিপরীত উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলছিল।’

এই বিভ্রাট আলাস্কায় পুতিন-ট্রাম্পের বৈঠকে সবার সামনেই প্রকাশ পায়। কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়াই সম্মেলন হঠাৎ সংক্ষিপ্ত করা হয়। পরে ট্রাম্প এবং পুতিন যখন একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আসেন, তখন তারা যুদ্ধ শেষের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের ঘোষণা দেননি।

পুতিনের কাছ থেকে ন্যূনতম প্রতিশ্রুতিও না পাওয়ায় বৈঠকের আয়োজক হিসেবে ট্রাম্প কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েন। পর্দার আড়ালে কী হয়েছে তা দুই পক্ষই স্পষ্ট করেনি; ফলে সাংবাদিকরা গোপন সূত্রে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন।

ফিনান্সিয়াল টাইমস জানায়, ট্রাম্প ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল এবং বাণিজ্য বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। পুতিন তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন এবং ইউক্রেনের আত্মসমর্পণ ও পুরো ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ দাবি করেন। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে পুতিন একটি “ঐতিহাসিক বক্তৃতা” দেন, যা ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করেছিল।

ইউরোপের এক কূটনীতিক বিবিসিকে বলেন, ‘আমেরিকানরা আলাস্কায় অগ্রগতির ঘাটতি দেখে সত্যিই হতাশ হয়েছিলেন।’

আরেকজন বলেন, ‘তারা ভুল বুঝেছিল রাশিয়ার জন্য যুদ্ধ আসলে কী অর্থ বহন করে।’

বাইডেন প্রশাসনের সময়ে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক রাশিয়া উপদেষ্টা এরিক গ্রিন বলেন, ‘সম্ভাব্য ছাড় ও বিনিময়ের বিষয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘‘অঞ্চল ছাড়াও নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয় ছিল, আর ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু মানুষ বুঝতে পারেনি পুতিন ‘যুদ্ধের মূল কারণ’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন।’’

ট্রাম্প নিজেও হতাশ হয়েছিলেন। অক্টোবরে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার সময় তিনি বলেন, ‘প্রতিবার ভ্লাদিমিরের সঙ্গে আলোচনা করি, ভালো কথা হয়, কিন্তু কিছুই এগোয় না।’

পুতিন আসলে কী চান?

মস্কোতে রাশিয়ার সরকারি অবস্থান সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খুব একটা বদলায়নি।

  • যুদ্ধ শেষের জন্য পুতিনের মূল শর্তগুলো হলো:
  • পাঁচটি ইউক্রেনীয় অঞ্চলে রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি।
  • ইউক্রেনের নিরপেক্ষ অবস্থান।
  • ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী কমানো।
  • রুশ ভাষার সাংবিধানিক সুরক্ষা।
  • পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।

রাশিয়া বলছে, একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক চুক্তির পরই যুদ্ধ থামবে। তবে ওয়াশিংটন ও কিয়েভের কাছে এটি অগ্রহণযোগ্য, কারণ তাদের মতে, আগে যুদ্ধবিরতি হতে হবে।

তিন বিষয়ে সমঝোতা জরুরি

অ্যান্ড্রু পিক বলেন, আলোচনায় অগ্রগতি আনতে হলে তিনটি বিষয়ে সমঝোতা জরুরি:

  • ভূখণ্ড : সীমান্ত নির্ধারণ।
  • ইউক্রেনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ : ন্যাটোর সদস্যপদ বা নিরপেক্ষতা।
  • ইউক্রেনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা : সেনাবাহিনীর আকার ও সামরিক নিশ্চয়তা।

তার মতে, এই বিষয়গুলোর কোনোটিতেই কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ট্রাম্প শুরুতে ভূখণ্ডের বিষয়ে আপসের ক্ষেত্রে নমনীয় ছিলেন। এপ্রিলে তিনি জানান, ক্রাইমিয়া রাশিয়ার মতোই থাকবে। মিডিয়া রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে তার দল ২০১৪ সালে এ অঞ্চলের অধিগ্রহণের স্বীকৃতির সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখেছিল। অক্টোবরে ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকেও ট্রাম্প ‘অঞ্চল বিনিময়’ প্রস্তাব তোলেন বলে রয়টার্স জানায়।

রাশিয়াও কিছুটা নমনীয়তার ইঙ্গিত দিয়েছিল। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, মস্কো হয়তো দক্ষিণ ইউক্রেনের বর্তমান ফ্রন্টলাইন ধরে সমঝোতা করতে পারে। তবে তিনি এটাও বলেন, রাশিয়া এখনো খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ডনবাস অঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চায়।

ইউরোপের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ‘ট্রাম্প তার ব্যবসায়িক মানসিকতায় “রিয়েল এস্টেট ডিল” চেয়েছিলেন।’ কিন্তু তিনি, ‘পুতিনের কাছে বিষয়টি শুধু ভূখণ্ডের বিষয় নয়—এটা ইউক্রেনের ওপর সার্বভৌমত্বের বিষয়।’

পুতিনের দাবি হলো কিয়েভের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা ও সামরিক সক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ। মস্কো যথাযথ ‘নিরপেক্ষতা’ এবং ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপক হ্রাস চায়। অন্যদিকে, কিয়েভ যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কাছ থেকে পোক্ত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দাবি করে।

পিক বলেন, ‘নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয়ে রাশিয়া একেবারেই নমনীয় না, ২০২২ সালেও ছিল না, এখনো না।’ তিনি উপসংহারে টানেন, ‘এখানে ব্যবধান ভূখণ্ডের প্রশ্নের চেয়ে অনেক বড়।’

বুদাপেস্ট শীর্ষ সম্মেলন ব্যর্থ, আলোচনায় অনীহা ও নিষেধাজ্ঞার চাপ

এই শরতে বুদাপেস্টে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা অচলাবস্থাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ফোনালাপের পর ট্রাম্প ও পুতিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভকে প্রস্তুতির দায়িত্ব দেন। তারা একবার কথা বললেও, কোনো বৈঠক হয়নি। ব্লুমবার্গ জানায়, রুবিও বুঝতে পারছিলেন মস্কোর অবস্থান বদলায়নি।

ফিনান্সিয়াল টাইমস জানায়, রাশিয়া আবারও তাদের বিশাল দাবিগুলো পুনরাবৃত্তি করে একটি স্মারকলিপি পাঠিয়েছে — যা মার্কিন কর্মকর্তাদের আরও হতাশ করেছে।

১২ নভেম্বর রুবিও বলেন, ‘আমরা কেবল বৈঠকের জন্য বৈঠক চালিয়ে যেতে পারি না’। পরদিন ল্যাভরভ বলেন, ‘রাশিয়া আলোচনায় অনিচ্ছুক—এই অভিযোগ ‘স্পষ্ট মিথ্যা’। মস্কো দ্বিতীয় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের জন্য প্রস্তুত, যদি তা ‘আলাস্কা শীর্ষ সম্মেলনের সুপরিকল্পিত ফলাফলের’ ওপর ভিত্তি করে হয়।

এদিকে ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্ররা ট্রাম্পের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করতে বেশ জোরেশোরেই চেষ্টা চালিয়েছে। শুরুতে ট্রাম্প সরাসরি পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইছিলেন কিয়েভকে পাশ কাটিয়ে, যা ইউক্রেন ও ইউরোপকে উদ্বিগ্ন করে। এরপর ট্রাম্প ইউক্রেন বিষয়ে তার স্বর নরম করেন। রাশিয়ার বিপরীতে, ইউক্রেন ওয়াশিংটনের সঙ্গে নমনীয় থেকেছে, যুদ্ধবিরতি ও মস্কোর সঙ্গে সম্ভাব্য আলোচনার মার্কিন প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে।

কিয়েভ এবং তার মিত্রদের জন্য লক্ষ্য ছিল সহজ: ট্রাম্পকে বোঝানো যে পুতিনের কাছে আত্মসমর্পণ ইউরোপীয় এবং মার্কিন নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমরা জানতাম যে তিনি অবশেষে বুঝতে পারবেন রাশিয়া সৎ বিশ্বাসে আলোচনা করছে না। আমাদের কাজ ছিল সময় কেনা এবং এটি কাজ করেছে।’
মস্কো অবশ্য ইউরোপকে দোষারোপ করছে। ল্যাভরভ বলেন, ‘ইউরোপীয়রা ঘুমোচ্ছে না, তারা এই প্রশাসনকে চাপ দিচ্ছে।’

আলাস্কা সামিটের তিন মাস পরও ক্রেমলিন ও হোয়াইট হাউজ কোনো সমঝোতার কাছাকাছি নেই।

অক্টোবরে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে প্রথম বড় নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়, রাশিয়ার বৃহৎ তেল কোম্পানিগুলোকে লক্ষ্য করে। মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বিবিসি পার্টনার সিবিএসকে বলেন, “আমরা যা করছি সবই পুতিনকে আলোচনার টেবিলে আনবে।”

অন্যদিকে পুতিন নিষেধাজ্ঞাকে ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর’ বলে মন্তব্য করেন, তবে বলেন রাশিয়া ‘চাপের মুখে নীতি বদলাবে না।’

কিছুদিন পরই মস্কো একটি পারমাণবিক সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়, যা ইঙ্গিত দেয় আলোচনা নয়, বরং নতুন করে শক্তির প্রদর্শন চলছে।

বিজ্ঞাপন

পাবনায় ভাতিজার হাতে ফুফু খুন !
১৪ নভেম্বর ২০২৫ ২৩:৩৬

আরো

সম্পর্কিত খবর