ঢাকা: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুইবার প্রশাসনিক গণভোট, আর একবার সাংবিধানিক গণভোট। প্রথম গণভোট হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। এর উদ্দেশ্য ছিল সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়া জিয়াউর রহমানের শাসনকাজের বৈধতা দেওয়া। দ্বিতীয়বার গণভোট হয় ১৯৮৫ সালে, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নীতি-কর্মসূচি ও নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দায়িত্ব পালনের ওপর জনগণের আস্থা যাচাইয়ের জন্য। আর সর্বশেষ গণভোট হয় ১৯৯১ সালে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
সময়ের পরিক্রমায় বহুবছর পর ফের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় গণভোট। আর এবারই প্রথম বাংলাদেশের মানুষ একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোটে অংশ নেবে। কিন্তু দু’টি ভোট একদিনে করার জন্য কতটা প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন, তাদের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী, সেইসঙ্গে দু’টি ভোট একই দিনে করার জন্য কোন কোন বিষয়গুলোকে শুরুতেই প্রাধান্য দিতে হবে ইসিকে- এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় বিগত গণভোটে অংশ নেওয়া নির্বাচন কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে দ্রুত কর্মপরিকল্পনা তৈরির পরামর্শ তাদের।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে গণভোটে দায়িত্ব পালন করেছি। এর আগে একসঙ্গে দুই ভোট ভোটাররাও দেননি, কোনো কমিশনও করেনি। একইদিনে দুই ভোট করতে গেলে জনবলের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কারণ, ভোটের সময় দু’টি ব্যালট থাকবে। একে ভোটারদের ভোট দিতেও সময় লাগবে বেশি। আবার গণনার সময়ও দ্বিগুণ জনবল লাগবে। একদল সংসদ নির্বাচনের ভোট গণনা করবে, আরেকদল গুনবে গণভোট। আর দুটি নির্বাচন একসঙ্গে করতে গেলে বুথ ও কেন্দ্র সংখ্যাও বাড়ানো লাগতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আবার গণভোটের প্রশ্নগুলো নিয়ে জনগণের কাছে কারা যাবে- রাজনৈতিক দলগুলো, নাকি সরকার? আবার যদি এমন হয় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে প্রশ্ন পড়ে ভোট দেবে, তাহলে অনেক সময় চলে যাবে। আবার যারা পড়তে জানে না, তাদের জন্য কী অপশন থাকবে- এগুলো তো চ্যালেঞ্জিং। তবে ভোটারদের সচেতনতা বাড়াতে রাজনৈতিক দলগুলোকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’
সাবেক এই নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, ‘জনবলের সক্ষমতা বাড়াতে ইসিকে আরও বেশি প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে হবে। যেমন- কোনো কেন্দ্রে যদি সংসদ ভোট বন্ধ হয়, তাহলে গণভোটের কী হবে? আইন যেহেতু চেঞ্জ করতে হবে, সেখানে এমন সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়- সেসব বিষয় নিয়েও ভাবতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।’
জেসমিন টুলী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যখন এ বিষয়ে আইন তা করবে, তখন বোঝা যাবে বাকি বিষয়গুলো কেমন হবে। যেমন- কেউ যদি বলেন, তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন না, শুধুমাত্র গণভোটে অংশ নেবেন; অথবা শুধু সংসদ সদস্য নির্বাচনে ভোট দেবেন, গণভোটে অংশ নেবেন না- সেক্ষেত্রে বিষয়গুলো কেমন হবে? কর্মকর্তারা সেসময় কী করবেন- এ বিষয়ে বিস্তর প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে হবে।’
তিনি মনে করেন, ভোটের সময় না বাড়িয়ে ভোট কক্ষ বাড়ানো দরকার। সেইসঙ্গে প্রিজাইডিং অফিসারদের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে দু’টি নির্বাচন একসঙ্গে করা সমস্যা হবে না।
এ বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংসদ নির্বাচন ও গণভোট দুটি আলাদা বিষয়। গণভোট নিয়ে মানুষের ধারণা একেবারেই কম। কাজেই গণভোট কী ও কেন- এটা নিয়ে ব্যাপক প্রচার ও সিভিক এডুকেশন দরকার পড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠেয় এই আয়োজনে কমিশনকেও প্রস্তুতিটা সেভাবেই নিতে হবে। দুই রকমের ব্যালট পেপার প্রস্তুত ও ব্যালট বাক্স আলাদা করতে হবে। ব্যালট পেপার ছাপা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং ভোটারদের এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা- সবই কমবেশি চ্যালেঞ্জিং কাজ।’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এই সদস্য বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটে রাজি। কোন সময় হবে, সেটা নিয়ে ভিন্নমত আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঐকমত্য। দলগুলো ঐকমত্য হলে কোনো চ্যালেঞ্জ থাকে না।’
এদিকে গণভোট প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সারাবাংলা বলেন, ‘একই দিনে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন জটিলতা সৃষ্টি করবে। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। দেশটাকে নতুন করে সাজাতে সুষ্ঠু গণভোটের বিকল্প নেই। তাই সবকিছুর আগে দরকার গণভোট নিয়ে বেশ ভালো একটা প্রস্তুতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একদিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট করলে কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। তবে সেই গণভোট কতটুকু জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারবে সেটাও বিবেচনায় আনা উচিত। এর আগে যেহেতু কখনো একসঙ্গে সংসদ ও গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি, সেহেতু এ বিষয়ে বিস্তর প্রস্তুতি নিতে হবে। গণভোট আয়োজন মূল টার্গেট হওয়া উচিত- বিষয়টির গুরুত্ব জনগণের ভেতর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া।’
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজনের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার পর, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সংসদ নির্বাচনের আয়োজনের জন্য যেখানে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করার কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন। সেখানে এখন গণভোটকে যুক্ত করে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে ইসিকে।
এ বিষয়ে কমিশন বলছে, একই দিনে নির্বাচন-গণভোট আয়োজনের বিষয়ে ইসি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। যদিও এরই মধ্যে ইসির বৈঠকে দুই ভোট একসঙ্গে আয়োজনে কী কী কাজ করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর জন্য বাড়তি অর্থ প্রয়োজন হবে। আর অতিরিক্ত ভোটকক্ষেরও প্রয়োজন হবে। তাই প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় দিতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেসঙ্গে অতিরিক্ত ভোটকক্ষের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।