‘পড়ে যাই, হোঁচট খাই, কিন্তু পোলার হাতটা ছাড়ি না’
২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৯:১৬
জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
‘সকাল সাড়ে সাতটায় পোলারে নিয়ে বাইর হই, অফিসে দিয়া আসি। বিকালে আবার গিয়া নিয়া আসি। আমি বুড়া মানুষ, ঢাকার রাস্তায় কোনো দিন হাঁটি নাই, চোখেও দেখি না ঠিক মতো। রাস্তায় হাঁটতে গেলে হোঁচট খাই, পইড়া যাই কিন্তু পোলার হাতটা ছাড়ি না’— বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন ৬৫ বছরের সুলেমা খাতুন।
সুলেমা খাতুন পুলিশের টিয়ারশেলের আঘাতে চোখ হারানো সিদ্দিকুর রহমানের মা।
কাঁদতে কাঁদতে সুলেমা খাতুন বলেন, ‘ওদেরকে অনেক ছোট রাইখা ওদের বাবা মারা যায়। কিন্তু তারপরও কোনো রকমে গ্রামের বাড়িতে সব সামলায়ে নিছি। কোনোদিন বাড়ির বাইরে যাইতে হয় নাই। কিন্তু এই বয়সে আইসা আল্লাহ আমারে ঢাকার শহর দেখাইল, বাড়ির বাইর করল। তাতেও আমার আপত্তি নাই। আমি না দেখলে কে দেখব আমার ছেলেরে? কিন্তু ছেলের কান্দন— আমি ছাড়া আর কেউ দেখে না। আমি মইরা গেলে ছেলেটারে কে দেখব?’
‘এই অন্ধ ছেলেরে নিয়ে আমি কই যাব?’ প্রশ্ন করে সুলেমা খাতুন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তো মানুষের জন্য কত কিছু করেন, আমার এই অন্ধ ছেলেরে যদি একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতেন, তাইলে মা ছেলে মিলে একটু ভালো থাকতাম।’
ঢাকার তেজগাঁয়ের মধ্য বেগুণবাড়ীতে নেওয়া ভাড়া বাসায় কথা হয় সুলেমা খাতুনের সঙ্গে। এই বাড়ির নিচতলায় দুইটি কক্ষ, সামনে একটু খানি বারান্দা। দুইটি কক্ষের একটিতে সাড়ে ছয় হাজার টাকায় ভাড়া থাকেন এই মা এবং ছেলে। সেখানে একটি খাট, একটি চকি, একটি স্টিলের আলমিরা আর রয়েছে একটি সিলিং ফ্যান। ঘর জুড়ে তার টানানো। সেখানে মা-ছেলের কাপড় শুকাতে দেওয়া।
গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এই খুঁপড়ি ঘরে থাকতে কেমন লাগে জানতে চাইলে চুপ থাকেন সুলেমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমার কপালে ছিল এটা, কষ্ট হয় না। কিন্তু রাতের বেলায় ছেলের কান্দনের শব্দ শুনে থাকতে পারি না। ছেলে আমার সারাদিন মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলে, নিজের কাজ করে। কিন্তু রাতের বেলায় যখন চোখের পানি ফেলে, শব্দ করে কানতে থাকে— সেই শব্দ আমি ছাড়া আর কেউ শোনে না।’
সিদ্দিকুরের বেতন দিয়ে সংসার চলে না, সাহায্য নিতে হয় পরিবারের অন্য সদস্য আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের। গ্রাম থেকে কেবল চালটা বড় ছেলে পাঠিয়ে দেয়, আর সব কিছুই কিনে খেতে হয় এই মা-ছেলের। আর তাতে করে কোনো কোনো দিন রান্না করার মতো কোনো সবজি থাকে না— এমন দিনও পার করতে হচ্ছে এই পরিবারের। ছেলেকে রুটি-সবজি দিয়ে সকালে অফিসে পাঠিয়ে সুলেমা খাতুন কেবল একটু মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দেন দিনটা। ছেলের জন্য রেখে দেন হাঁড়িতে থাকা সবজির বাকিটুকু, আর সেটুকু দিয়েই রাতের ভাতটা খান সিদ্দিকুর, কিন্তু ভাগ্য যে ছেলে চোখে দেখতে পাচ্ছেন না, আর তাইতো রক্ষা হয় মায়ের। তার না খেয়ে থাকার দৃশ্যটা ছেলেকে দেখতে হয় না।
চোখ মোছেন-কথা বলেন সুলেমা খাতুন। আর তাই হয়তো নীরব শ্রোতা পেয়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘প্রথম মাসে ৬ হাজার ৯ শ’ টাকা আর তার পরের মাসে ৯ হাজার চল্লিশ টাকা বেতন পেয়েছে ছেলেটা। এই ঘরের ভাড়া সাড়ে ৬ হাজার টাকা, কেমনে কর সংসার চালাই? গ্রামের বাড়ি থেকে বড় পোলাটা চাউল পাঠায়, আর সব তো কিনতেই হয়-সিদ্দিকুরের। স্যার-ম্যাডামরা টাকা পাঠায়, বন্ধুরা বাজার করে দিয়ে যায়। ঘরে কিছু না থাকলে তো আমি ছেলেরে বলতে পারি না, ও কী করবে, কেউ এক শ’ টাকা ওর হাতে দিলেও সেইটা আমার হাতে দেয়। এর বেশি কিছুর ক্ষমতা তো পোলাডার নাই।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিদ্দিকুরকে দেখতে গিয়ে চাকরি দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য চেন্নাই এর শংকর নেত্রালয়ে যান সিদ্দিকুর। কিন্তু ভাগ্য ফেরেনি তার, চোখে আলো ফিরে আসেনি। চেন্নাই থেকে ফিরে আসার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগসে চাকরি হয় সিদ্দিকুরের। অফিসের কাছে বাসা নিতে হবে বলেই মধ্য বেগুণবাড়ীর এই ছোট্ট ঘরে মিলে থাকছেন মা ছেলে।
এত বড় ঘটনা ঘটল আমাদের জীবনে, আমার লেখাপড়া জানা পোলাডা অন্ধ হইয়া গেল। কিন্তু এই চাকরিটাই কী তার প্রতিদান নাকি— সে প্রশ্নও তোলেন সুলেমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো কেস-কাচারি করলাম না, কারো বিরুদ্ধে আমার ছেলে অভিযোগও করে নাই, কিন্তু প্রতিদানে আমরা কী পেলাম?’
কথা বলতে বলতে বিকাল হয়। সুলেমা খাতুন জানালেন, ছেলের অফিস ছুটির সময় হয়েছে, তাকে নিয়ে আসতে হবে। সাত রাস্তার অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগস থেকে ছুটি হয় সিদ্দিকুরের।
সিদ্দিকুর সারাবাংলার মাধ্যমে কৃতজ্ঞা জানান অফিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসানুল কবীর জগলুসহ সব সহকর্মীদের প্রতি। সিদ্দিকুর বলেন, ‘এমডি স্যার প্রতিদিন একবার করে খোঁজ নেন, সহকর্মীদের সাহায্য ছাড়া এখানে আমার কাজ করাটা কঠিন হতো, যারা চোখে দেখেন না, তাদের জন্য আশেপাশের মানুষগুলো চোখ হয়ে কাজ করে, হাতের লাঠি হয়ে তারা পথ দেখায়।’
পরীক্ষার রুটিন ও তারিখ ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবিতে গত ২০ জুলাই শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের টিয়ারশেলে আঘাতে গুরুতর আহত হন তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান। পরে তার চিকিৎসা হয় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে চেন্নাই-এর শংকর নেত্রালয়ে পাঠানো হলেও দৃষ্টিশক্তি ফেরেনি সিদ্দিকুরের।
তবে যে পরীক্ষার দাবি জানাতে গিয়ে চোখ হারান তিনি, গত ২৮ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন সিদ্দিকুর। একজন শ্রুতি লেখকের সাহায্যে সে পরীক্ষা দেয়। তবে পরীক্ষা নিয়ে তৃপ্ত সিদ্দিকুর বলেন, ‘পরীক্ষা দিয়ে আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে।’
আর প্রতিটি পরীক্ষার সময়ে সিদ্দিকুর দুপুরে গিয়ে বাসায় ভাত খেতেন তার চিকিৎসক ডাক্তার জাহিদুল আহসান মেননের বাসায়। সে কথা জানিয়ে সিদ্দিকুর বলেন, ‘স্যারের বাসা তিতুমীর কলেজের পাশেই। প্রতিটি পরীক্ষার দিন স্যারের বাসায় গিয়ে ভাত খাওয়া ছিল নির্দেশ। এই মেনন স্যার আমার সঙ্গে চেন্নাইতে গিয়েছিলেন। আমি ছিলাম তার রোগী। কিন্তু রোগী-চিকিৎসকের সর্ম্পক ছাড়িয়ে তিনি যেভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিন তাতে আমার সারাজীবনের কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি।’
লেখাপড়াটা তিনি চালিয়ে যাবেন— দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সিদ্দিকুর। তিনি বলেন, ‘যে লেখাপড়ার কারণে পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেল, সেই লেখাপড়ার শেষটা আমি দেখতে চাই, আর তাতে পাশে চাই আপনাদের সবাইকে।’
https://www.youtube.com/watch?v=XFZw42hHt_w
সারাবাংলা/জেএ/আইজেকে