পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ থাকার কারণে তীব্র আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে ভারতের একমাত্র প্রধান আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া। এই বিপুল লোকসান সামাল দিতে এবার এক অভূতপূর্ব কূটনৈতিক পদক্ষেপের দিকে ঝুঁকছে টাটা গ্রুপের মালিকানাধীন এই সংস্থা। রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানা গেছে, এয়ার ইন্ডিয়া ভারতীয় সরকারের কাছে জোর লবিং শুরু করেছে—যাতে দিল্লি কূটনৈতিকভাবে চীনকে বোঝাতে পারে এবং জিনজিয়াংয়ের অত্যন্ত সংবেদনশীল সামরিক আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া যায়।
দীর্ঘ দূরত্বের রুটে জ্বালানি খরচ ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি এবং ভ্রমণের সময় তিন ঘণ্টা বেড়ে যাওয়ায় বিমান সংস্থাটি চরম অপারেশনাল চাপে রয়েছে। বার্ষিক ৪৫৫ মিলিয়ন ডলার লোকসানের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এয়ার ইন্ডিয়া তাই হোতান (Hotan)-এর মতো কৌশলগত রুট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য মরিয়া। যদিও এই আকাশপথটি চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের অধীনে এবং নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক ঝুঁকির কারণে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলো তা এড়িয়ে চলে। এই জটিল সামরিক আকাশসীমার ব্যবহারের জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার আবেদন চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন এক সংবেদনশীল দিক উন্মোচন করলো।
বুধবার (১৯ নভেম্বর) রয়টার্সের প্রতিবেদনে তথ্য জানানো হয়।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘ পাঁচ বছরের বিরতির পর হিমালয় সীমান্তে ভারত-চীনের সংঘাতের কারণে বন্ধ থাকা সরাসরি ফ্লাইটগুলো পুনরায় শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরে এই অনুরোধটি এলো।
গত এপ্রিলের শেষের দিকে কূটনৈতিক উত্তেজনা শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোর জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ রয়েছে। দেশের একমাত্র প্রধান আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক বহনকারী এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য এটি গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
রয়টার্স পর্যালোচিত এবং ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছে জমা দেওয়া অপ্রকাশিত নথি অনুসারে, কিছু দীর্ঘ দূরত্বের রুটে এয়ার ইন্ডিয়ার জ্বালানি খরচ ২৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভ্রমণের সময় তিন ঘণ্টা পর্যন্ত বেড়েছে।
এয়ার ইন্ডিয়া অনুমান করেছে, পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ থাকার কারণে তাদের বার্ষিক কর-পূর্ব মুনাফার ওপর ৪৫৫ মিলিয়ন ডলারের প্রভাব পড়ছে। উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদের লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৩৯ মিলিয়ন ডলার।
এয়ার ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে ভারতীয় সরকারের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে, তারা যেন কূটনৈতিকভাবে চীনকে অনুরোধ করে যেন হোতান, Kashgar এবং Urumqi-এর মতো জিনজিয়াং অঞ্চলের বিমানবন্দরগুলোতে বিকল্প রুট এবং ডাইভারশনের ক্ষেত্রে জরুরি অ্যাক্সেস দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপে দ্রুত পৌঁছাতে পারবে।
নথিতে বলা হয়েছে, ‘এয়ার ইন্ডিয়ার দীর্ঘ দূরত্বের নেটওয়ার্ক চরম অপারেশনাল এবং আর্থিক চাপে রয়েছে… হোতান রুট সুরক্ষিত করা একটি কৌশলগত বিকল্প হবে।’
হোতান আকাশসীমা কেন এত সংবেদনশীল?
এয়ার ইন্ডিয়া যে চীনা আকাশসীমাটি ব্যবহার করতে চাইছে, তা কয়েকটি কারণে অত্যন্ত সংবেদনশীল।
প্রথমত ভৌগোলিক ঝুঁকি। এই আকাশসীমাটি ৬ হাজার ১০০ মিটার বা তার বেশি উচ্চতার বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত। ডিকম্প্রেশনের মতো কোনো ঘটনা ঘটলে সম্ভাব্য নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলো সাধারণত এটি এড়িয়ে চলে।
এর পরে আছে সামরিক গুরুত্ব। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই অঞ্চলটি চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের অধীনে পড়ে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং বিমান-প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত এবং কিছু বিমানবন্দর বেসামরিক বিমানের সঙ্গে ভাগ করে নেয়।
এ ছাড়াও আছে ভারত-চীন সংঘাত। ডিসেম্বরে প্রকাশিত পেন্টাগনের চীন সামরিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে এই কমান্ডের দায়িত্বের মধ্যে ভারতের সঙ্গে যেকোনো সংঘর্ষের জবাব দেওয়াও অন্তর্ভুক্ত। সামরিক বিশ্লেষক ড্যামিয়েন সাইমন জানিয়েছেন, চীন সম্প্রতি হোতানে তাদের বিমানঘাঁটি সম্প্রসারিত করেছে।
পাকিস্তান আকাশসীমা বন্ধ হওয়ার পর এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লি-ওয়াশিংটন রুটটি আগস্ট মাসে স্থগিত করা হয়। অন্যান্য রুটগুলোও এখন পর্যালোচনাধীন। মুম্বাই এবং বেঙ্গালুরু থেকে সান ফ্রান্সিসকোতে সরাসরি ফ্লাইটগুলো অতিরিক্ত তিন ঘণ্টা সময় লাগার কারণে (যার মধ্যে কলকাতায় একটি প্রযুক্তিগত বিরতিও অন্তর্ভুক্ত) ‘অসাফল্য’ হয়ে উঠছে।
নথিতে বলা হয়েছে, ‘যাত্রীরা স্বল্প সময়ের ফ্লাইটের কারণে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোতে চলে যাচ্ছে কারণ তারা পাকিস্তানের ওপর দিয়ে যাওয়ার সুবিধা পাচ্ছে।’
এয়ার ইন্ডিয়া অনুমান করছে, চীনের হোতান রুটের মাধ্যমে অতিরিক্ত জ্বালানি প্রয়োজনীয়তা এবং ফ্লাইটের সময় যথেষ্ট কমানো সম্ভব হবে। এতে নিউ ইয়র্ক এবং ভ্যানকুভার-দিল্লি রুটে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা যাত্রী ও পণ্যবাহী সক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে এবং প্রতি সপ্তাহে আনুমানিক ১ দশমিক ১৩ মিলিয়ন ডলার লোকসান কমানো যেতে পারে।
আকাশসীমা নিষেধাজ্ঞার কোনো শিথিলতার লক্ষণ না দেখে এয়ার ইন্ডিয়া নথিতে ‘পাকিস্তান আকাশসীমা খোলা না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী ভর্তুকি’ চেয়েছে।
এ ছাড়াও, এয়ার ইন্ডিয়া পুরোনো ট্যাক্স সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানেও সহায়তা চাইছে। ২০২২ সালে টাটা গ্রুপের কাছে বিক্রির সময় ভারত সরকার এয়ারলাইনটিকে পুরোনো বকেয়া থেকে দায়মুক্ত করার আশ্বাস দিলেও, ৭২৫ মিলিয়ন ডলারের পুরোনো করের দায় সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি নোটিশ পাওয়া গেছে, যা আইনি এবং সুনামগত ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। একটি গোপন সরকারি নোটিশে (মার্চ মাসে রয়টার্স কর্তৃক দেখা) কর কর্তৃপক্ষ ৫৮ মিলিয়ন ডলার বকেয়া আদায়ের জন্য ‘জোরপূর্বক পদক্ষেপ’ (যেমন সম্পদ জব্দ করা) গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছিল।
এয়ারলাইন জানিয়েছে, এই ধরনের কর দাবির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ফলে ‘অতিরিক্ত নগদ প্রবাহের বোঝা বাড়ছে, যদিও বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সময় আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।