বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত বছর সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষ পাঁচ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য বারবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ সত্ত্বেও তা আমলে নেয়নি দিল্লি। বিষয়টি ১৫ মাস ধরে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।
শেখ হাসিনাকে ভারত আদৌ বাংলাদেশে হস্তান্তরে আগ্রহী কিনা, এ নিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরায় এই বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সীমা আক্তার। ২৪ বছর বয়সী এই তরুণী ফুটবল অনুশীলন করছিলেন। ঠিক তখনই তার এক বন্ধু তাকে থামিয়ে একটি খবর দিলেন— বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর কাছে মুহূর্তটি যেন এক ধরনের ন্যায়বিচার পূরণের অনুভূতি হয়ে ধরা দিল।
গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নে সীমার বেশ কয়েকজন বন্ধু নিহত হন। দীর্ঘ তদন্ত ও কয়েক মাসের বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৭৮ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ নেত্রীকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেন। গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী দমন অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে আদালত প্রমাণ পেয়েছে।
ঢাকা থেকে সীমা আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভাবতেন, তাকে কেউ হারাতে পারবে না, চিরকাল ক্ষমতায় থাকবেন। তার মৃত্যুদণ্ড আমাদের শহীদদের প্রতি ন্যায়বিচারের পথে একটি পদক্ষেপ।’ তবে সীমা যোগ করেন, শুধু রায় ঘোষণা যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই তাঁকে ঢাকাতেই ফাঁসি দেওয়া হোক!’
কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। ২০২৪ সালের আগস্টে বিক্ষোভকারীরা হাসিনার সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়ার পর হাসিনা ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। এখন তিনি দিল্লিতে নির্বাসনে, গারদের বাইরে বহু দূরে। দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকার পরও গত ১৫ মাসে বাংলাদেশের বারবার আনুষ্ঠানিক অনুরোধেও ভারত সাড়া দেয়নি।
এই অবস্থানই দুই দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর সম্পর্কে বড় ধরনের উত্তেজনার উৎস। এখন, মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর এই উত্তেজনা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও নয়াদিল্লি ঢাকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী, তবুও বহু ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে—মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি দিল্লি কল্পনাও করতে পারছে না।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘দিল্লি কীভাবে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে!’
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রফেসর সঞ্জয় ভরদ্বাজ কাতার-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, ‘ভারত এই ঘটনাকে (হাসিনার মামলা) বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখছে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এখন ভারত বিরোধীদের দ্বারা চলছে। প্রফেসর ইউনূস প্রায়শই ভারতের সমালোচনা করেছেন। যারা হাসিনাকে হটিয়ে দিয়েছে, সেই বিক্ষোভকারীরা হাসিনাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য ভারতকে দোষারোপ করে। এই পরিস্থিতিতে যদি হাসিনাকে হস্তান্তর করা হয় তাহলে, যারা ভারত বিরোধীতা করছেন তাদের বৈধতা দেওয়া হবে।’
অন্যদিকে হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ও আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত চাওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ভারত বলছে, হাসিনার রায়ের বিষয়ে ভারত অবগত হয়েছে এবং তারা সব সময় সব অংশীজনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, তারা বিশেষ করে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তবে বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো না। হাসিনার সময় দিল্লির সঙ্গে ঢাকার যে সমৃদ্ধশীল অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা এখন অবিশ্বাসের সম্পর্কে রূপ নিয়েছে।
ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, শিগগিরই এ অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে তিনি মনে করেন না।
আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘এই সরকারের (বাংলাদেশ) অধীনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে যাবে। কারণ, তারা বারবার বলতে থাকবে, ভারত আমাদের কাছে হাসিনাকে ফেরত দিচ্ছে না।’
পিনাক চক্রবর্তী মনে করেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সূচনা হতে পারে। যদিও নির্বাচনে হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বড় বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বড় রাজনৈতিক শক্তি ভারতের সমালোচক। তবু নির্বাচিত প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করাটা ভারতের জন্য স্বস্তির হবে।
শ্রীরাধা দত্ত বলেন, হাসিনার বিষয়ে ভারত জটিলতার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তার প্রতি জনগণের ক্ষোভকে তারা উপেক্ষা করতে পারে না।
তার মতে, ভারত এখন নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। যখন নির্বাচিত কোনো সরকার আসবে তখন হয়ত সম্পর্ক ভালো হবে। তিনি বলেন, “ভারতকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। বাণিজ্য ও অন্যান্য বিষয়কে সম্মন্নত রাখতে হবে। কিন্তু অন্য বিষয়গুলো নিয়ে ঝামেলা করা যাবে না।”
ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘হাসিনার বিষয়ে ভারত জটিলতার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তার প্রতি জনগণের ক্ষোভকে তারা উপেক্ষা করতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই নয়াদিল্লি চায় ভবিষ্যতে কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরুক এবং তিনি (হাসিনা) ভারতের জন্য সব সময়ই সর্বোত্তম পছন্দ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতকে মানতে হবে বাংলাদেশে হাসিনাকে আর কখনো সুযোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর পরিবর্তে ভারতের উচিত, ঢাকার অন্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা।’