Wednesday 19 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কপ-৩০
জীবাশ্ম জ্বালানি ‘ফেইজ আউট’ ও জলবায়ু ‘রোডম্যাপ’র দাবি উত্থাপন

উজ্জল জিসান স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২০ নভেম্বর ২০২৫ ০০:০১

কপ-৩০ সম্মেলন। ছবি: সংগৃহীত

ব্রাজিলের বেলেম থেকে: কপ৩০-এর নবম দিনটি নানা রাজনৈতিক উত্তেজনা, সামাজিক প্রতিরোধ এবং ভবিষ্যৎ চুক্তিসংক্রান্ত ইঙ্গিতের সমন্বয়ে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। সম্মেলনে আদিবাসী বিক্ষোভকারীদের জন্য ‘বর্জন এলাকা’ নির্ধারণ করায় সমালোচনা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি এ বছর শিল্প-খাতের শত শত কৃষি লবিস্ট উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক আলোচনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যেই প্রথমবারের মতো সম্ভাব্য চূড়ান্ত চুক্তির খসড়ায় জীবাশ্ম জ্বালানির ‘ফেইজ আউট’র বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় অনেক দেশই এটিকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছে।

সিয়েরা লিওন, কেনিয়া, জার্মানিসহ ৮০টির বেশি দেশের মন্ত্রীরা একসঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ফেইজ আউট রোডম্যাপের আহ্বান জানান। এমনকি যুক্তরাজ্যের এনার্জি সেক্রেটারি এড মিলিব্যান্ডও তাদের এ দাবিকে শক্তভাবে সমর্থন করেন। মার্শাল আইল্যান্ডস, ভানুয়াতু ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিরা বলেন, ‘১.৫°C লক্ষ্য ধরে রাখতে এবং দুর্বল এনডিসিগুলো শক্তিশালী করতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর কোনো বিকল্প নেই।’

বিজ্ঞাপন

যদিও ব্রাজিল শুরুতে এ বিষয়টি আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচিতে রাখেনি, তবুও নতুন খসড়ায় রোডম্যাপকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনেক দেশের কাছে খসড়াটিকে এখনো দুর্বল বলে মনে হচ্ছে। তারা আরও সুস্পষ্ট ও বাস্তবায়নকেন্দ্রিক পরিকল্পনা চান। এই রোডম্যাপ সব দেশের জন্য একরকম হবে না। কারণ, প্রতিটি দেশই ভিন্ন ভিন্ন জ্বালানি বাস্তবতা ও উন্নয়ন চাহিদার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। তবে জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিয়ে সব দেশের অবস্থান অভিন্ন।

সৌদি আরবসহ কয়েকটি পেট্রোস্টেটের কঠোর বিরোধিতায় ঐকমত্য পাওয়া কঠিন হলেও সমর্থনকারী দেশগুলো মনে করছে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রাজিলের ভেতরেও মতভেদ রয়েছে। প্রেসিডেন্ট লুলা জীবাশ্ম নির্ভরতা কমানোর কথা বললেও সরকারের একটি অংশ তেল-গ্যাসের ব্যবহার সম্প্রসারণের দিকে ঝুঁকে আছে। তবে পরিবেশমন্ত্রী মারিনা সিলভা জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউটের রোডম্যাপকে জলবায়ু সংকটের ‘নৈতিক জবাব’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

জাস্ট ট্রানজিশন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে আলোচিত হলেও এখনো দেশগুলোকে শ্রমিকদের ওপর নীতি পরিবর্তনের প্রভাব নিরীক্ষা বা অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার কোনো বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয় না। নতুন প্রস্তাবনাটি এই ঘাটতি পূরণে বৈশ্বিক পর্যায়ে সমন্বিত, দ্রুত ও সমর্থিত একটি প্রকৃত জাস্ট ট্রানজিশন কাঠামো তৈরির আহ্বান জানায়। গত সপ্তাহে জি৭৭ ও চীনের আনুষ্ঠানিক সমর্থন এই এজেন্ডাকে বড় অগ্রগতি এনে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জাস্ট ট্রানজিশন প্রতিশ্রুতিগুলোকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করলে জলবায়ু পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন বাড়বে। কারণ, শুধু নতুন সবুজ কর্মসংস্থান নয়, সেই কাজগুলোর মান স্থিতিশীলতা, বেতন ও সুবিধা নিশ্চিত করাও মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমান অর্থনীতির তুলনায় নিম্নমানের চাকরি হলে শ্রমিকরা নতুন সবুজ খাতে যেতে আগ্রহী হবেন না, আর তাই নীতিগত পরিবর্তনে শ্রমিক সুরক্ষা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে জলবায়ু অভিযোজন তহবিলে ধনী দেশগুলোর অপ্রতুল অর্থায়ন উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিদের হতাশ করছে। জলবায়ু অভিযোজনের অগ্রগতি কীভাবে পরিমাপ করা হবে তা নিয়েও আলোচনায় মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, বৈশ্বিক যুব নেতৃত্ব এ সম্মেলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। তৃতীয় এবং চূড়ান্ত যুব-নেতৃত্বাধীন জলবায়ু ফোরামে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশের ৩০ হাজারেরও বেশি তরুণ ‘গ্লোবাল ইয়ুথ স্টেটমেন্ট’ উপস্থাপন করে, যেটি এখন পর্যন্ত শিশু ও তরুণদের সবচেয়ে বড় সম্মিলিত জলবায়ু আহ্বান। এই স্টেটমেন্টে দ্রুত, ন্যায়সঙ্গত ও সম্পূর্ণ জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউট, আন্তঃপ্রজন্ম ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ, ন্যায়ভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়ন, এবং অভিযোজনকে ‘নৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রাধিকার’ ঘোষণার দাবি জানানো হয়।

ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ ও পরিবেশগত ক্ষতির জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করতে যাচ্ছে। নির্গমন বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু-উষ্ণতা বাড়ার কারণে প্রথমবারের মতো কোনো দেশ এমন আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিপূরণের দাবি তুলল। ইউক্রেনের অর্থনীতি, পরিবেশ ও কৃষি উপমন্ত্রী পাভলো কার্তাশভ জানান, যুদ্ধের কারণে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি, সিমেন্ট, ইস্পাত ব্যবহার, বনজ সম্পদ ধ্বংস এবং অগ্নিকাণ্ডের ফলে পানি, জমি ও বনভূমির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া, বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয়েছে। ব্রাজিলে কপ-৩০ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি জানান, এসবের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতিপূরণ দাবি করা হচ্ছে।

পূর্ব হিমালয়ের কোলে অবস্থিত বৌদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্রবিন্দু ভুটান বিশ্বের অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষী জলবায়ু নেতৃস্থানীয় দেশ। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বলেন, ‘বিশ্বের প্রথম কার্বন-নেগেটিভ দেশ হিসেবে ভুটানের সাফল্যের মূল রহস্য হলো জনগণের সুখ, কল্যাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। সীমিত সম্পদ ও ভৌগোলিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দেশটি পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পদক্ষেপ, সামাজিক উন্নতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষাকে জাতীয় অগ্রাধিকারে রেখেছে।’ এটি ধনী পশ্চিমা দেশগুলোর জন্যও অনুকরণীয় বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, ‘হাইড্রো, সৌর, বায়ু ও গ্রিন হাইড্রোজেনসহ সকল খাতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নিরসন পরিকল্পনার মাধ্যমে ভুটান প্যারিস চুক্তির ১.৫°C লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে। মাত্র ৭ দশমিক ৫ লাখ জনসংখ্যার এই হিমালয়ান দেশটির ৭২ শতাংশ বনভূমি কার্বন শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এবং সংবিধানে ন্যূনতম ৬০ শতাংশ বন আচ্ছাদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণে সহায়তা কমে যাওয়ায়, পাহাড়ি উষ্ণায়ন, হিমবাহ গলন ও বন্যার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ু অর্থায়ন চ্যালেঞ্জ বাড়ছে।’

গতবছর ভুটান পানামা, সুরিনাম ও মাদাগাস্কারকে সঙ্গে নিয়ে কার্বন-নেগেটিভ ও কার্বন-নিউট্রাল দেশগুলোর জি-জিরো জোট গঠন করে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় প্রভাব বিস্তারের উদ্যোগ নেয়। তোবগে বলেন, ‘জিডিপি কিংবা নির্গমন হ্রাস সবকিছুরই লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের সুখ, স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা।’

ক্যারিবীয় দাসপ্রথা ক্ষতিপূরণ কমিশন যুক্তরাজ্যে তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক সফরে জানান যে, ব্রিটিশ ট্রেজারি ‘দেউলিয়া করে দেওয়া’ বা ট্রিলিয়ন পাউন্ড দাবি করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং তারা ঔপনিবেশিক শাসন ও দাসপ্রথার দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি মোকাবিলায় পারস্পরিকভাবে উপকারী পুনরুদ্ধারমূলক ন্যায়বিচারের সমাধান খুঁজছে। ১৫০০ থেকে ১৯০০ শতাব্দীর মধ্যে ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি আফ্রিকানকে অপহরণ করে দাস হিসেবে আমেরিকায় বিক্রি করা হয়েছিল, যার প্রভাব এখনো ক্যারিবীয় সমাজ–অর্থনীতিতে বিদ্যমান। সেই কারণেই অঞ্চলটির সরকার আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা, ঋণ মওকুফসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবি তুলছে। কপ-৩০-এ মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের শিকড় ঔপনিবেশিকতা ও দাস ব্যবস্থায় রয়েছে উল্লেখ করে ক্ষতিপূরণ ইস্যুটি আলোচনায় আনার আহ্বান জানায়।

আগামী বছরের কপ অস্ট্রেলিয়া নাকি তুর্কিতে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে এখনো কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ জানিয়েছেন, তার দেশ তুরস্কের কপ-৩১-এর আয়োজক হওয়ার পথে বাধা দেবে না, তবে তিনি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাবেন। ২০২৬ সালের কপ আয়োজক দেশ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও তুরস্কের কাছ থেকে সম্মতি না পেলে জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী সম্মেলন জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হতে পারে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু ঐক্যের জন্য নেতিবাচক বার্তা দেবে।

আলবানিজ আরও বলেন, ‘তুরস্ক আয়োজক হলে অস্ট্রেলিয়া ভেটো দেবে না। তবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিশেষ নেতৃবৈঠক ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য জলবায়ু সহনশীলতা তহবিলে বাড়তি অর্থায়নের দাবি থাকবে।’ যদিও তুরস্কের পক্ষ থেকে কোনো সমঝোতার ইঙ্গিত নেই এবং প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রার্থিতা প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। পশ্চিম ইউরোপ ও অন্যান্য রাষ্ট্রগোষ্ঠী অস্ট্রেলিয়াকে ২৩টি ভোটের মাধ্যমে সমর্থন করলেও দুই দেশের মধ্যকার প্রতিযোগিতা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

আরো

উজ্জল জিসান - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর