Thursday 20 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অবশেষে সংশয় কাটল, কপ৩১-এর আয়োজক তুরস্ক

উজ্জল জিসান স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২০ নভেম্বর ২০২৫ ২৩:০৫

কপ৩১-এর আয়োজক তুরস্ক। ছবি: সংগৃহীত

ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো থেকে: অবশেষে সংশয় কেটেছে। আগামী বছর অস্ট্রেলিয়া নয়, জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন (কপ৩১) আয়োজন করবে তুরস্ক। যদিও দেশটি গত ১৭ নভেম্বর কপ আয়োজন থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

বুধবার (১৯ নভেম্বর) কপ৩০-এর দশম দিনের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এদিন তীব্র প্রতিযোগিতার পর তুরস্ক কপ৩১ আয়োজক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। প্রথম দিকে নিজেদের সরে নিলেও পরে অনড় অবস্থানের কারণে আয়োজক দেশ হিসেবে শেষ পর্যন্ত তুরস্কই নির্বাচিত হয়। আর অস্ট্রেলিয়া আগামী বছরের কপ৩১ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সহ-আয়োজক হওয়ার পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়ানোয় পাপুয়া নিউগিনি তীব্র হতাশা প্রকাশ করেছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে তুভালুর সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্তকে ‘অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ু ন্যায়বিচারে অঙ্গীকারের অভাব’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক নতুনভাবে ভাবার প্রয়োজনীয়তা তোলেন। যদিও অস্ট্রেলিয়া দাবি করেছে যে, আয়োজক না হলেও তারা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জলবায়ু সংকটকে আলোচনার কেন্দ্রে রাখার চেষ্টা করবে। তবুও নেতারা মনে করেন, এ সুযোগ হারানো হলেও প্রশান্ত মহাসাগরের জলবায়ু ন্যায়বিচারের লড়াই চলবেই।

পুরো দিনজুড়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা বৈশ্বিক জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণ ও বন উজাড় বন্ধের রোডম্যাপ এগিয়ে নিতে সবাইকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বিশ্ব একটি বিপজ্জনক সংকটে পড়বে। কপ সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো বলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ–আউট ইস্যুতে অধিকাংশ দেশেরই স্বার্থ জড়িত রয়েছে।’ ইউএন জলবায়ু আলোচনা এখন ‘জীবাশ্ম জ্বালানিকে রক্ষার বিশাল কনভেনশনে’ পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করেন কলম্বিয়ার সাবেক পরিবেশমন্ত্রী সুসানা মুহাম্মদ। পাওয়ার শিফট আফ্রিকার পরিচালক মোহাম্মদ আদউ উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু অর্থায়নে আরও দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানান। অপরদিকে পাপুয়া নিউগিনির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাস্টিন টকাচেঙ্কো পুরো কপ প্রক্রিয়াকেই অকার্যকর ও বড় দূষণকারীদের জবাবদিহিতাহীন একটি ‘টক-ফেস্ট’ বলে সমালোচনা করেন। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে কপ সম্মেলনে তাদের স্বল্প প্রভাব ও বাস্তব সমাধানের অভাবের অভিযোগ করে আসছে, বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু দুর্যোগের বাড়তে থাকা চাপের প্রেক্ষাপটে।

জাতিসংঘের পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর ও টেকসই পরিবেশের অধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক অ্যাস্ট্রিড পুয়েন্তেস রিয়ানো কপ-এর আলোচনায় মানবাধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার আন্তর্জাতিক আইনগত বাধ্যবাধকতার একটি স্পষ্ট তালিকা উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, ‘আলোচনাগুলো এখনো অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভর ও অর্থনৈতিক স্বার্থকেন্দ্রিক হলেও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে যে, স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকার সব মানবাধিকারের পূর্বশর্ত এবং রাষ্ট্রগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক। পুয়েন্তেসের মতে, স্বীকৃত মানবাধিকার হিসেবে পরিচ্ছন্ন বায়ু, নিরাপদ জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা, নিরাপদ খাদ্য ও পানি, দূষণমুক্ত পরিবেশ, তথ্যপ্রাপ্তি, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, সমুদ্র আইন ট্রাইব্যুনাল এবং আন্তঃআমেরিকান মানবাধিকার আদালতের পরামর্শমূলক মতামত স্পষ্ট করেছে যে, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সব রাষ্ট্রেরই কঠোর সতর্কতার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে তারা জলবায়ু চুক্তির পক্ষভুক্ত হোক বা না হোক।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘কপ৩০-এর জাস্ট ট্রানজিশন, অভিযোজন ও জলবায়ু অর্থায়নসহ সব চুক্তিকে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে এগোতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপের জন্য IPCC–এর বৈজ্ঞানিক তথ্য, জীবাশ্ম জ্বালানিই সঙ্কটের মূল কারণ এই স্বীকৃতি ও পূর্ববর্তী বৈশ্বিক অঙ্গীকারকে মান্য করা অপরিহার্য।’

কপ৩০–এর সভাপতি ও ব্রাজিলের অভিজ্ঞ জলবায়ু কূটনীতিক আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো বলেছেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের বিষয়ে আলোচনায় ফাঁকফোকর কমাতে তেলউৎপাদক দেশগুলোকে ক্লিন এনার্জির ক্রমবর্ধমান অগ্রগতিকে স্বীকার করতে হবে এবং উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু অর্থায়নে আরও নিশ্চয়তা দিতে হবে।’ তিনি জানান, উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ন্যায্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা আশা করছে, যা নতুন অর্থ সংযোজন ছাড়াই বিদ্যমান তহবিলের কার্যকর ব্যবহার, বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড বা ঋণ–বিনিময়ে প্রকৃতি সংরক্ষণ চুক্তির মতো উদ্ভাবনী পদ্ধতির মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বৈশ্বিক উত্তরণ এখন কপ৩০–এর সবচেয়ে বড় বিভাজনরেখা। ৮০টিরও বেশি দেশ এই উত্তরণের রোডম্যাপ দাবি করলেও সৌদি আরবসহ তেলনির্ভর রাষ্ট্রগুলোর কঠোর বিরোধিতা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে ঝুঁকিতে ফেলছে। কারণ, কপ চুক্তির জন্য সর্বসম্মতি প্রয়োজন।’

দো লাগো বলেন, ‘দেশগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নেট–জিরোতে পৌঁছানোর নিজস্ব লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রসারসহ বিভিন্ন কারণে ভবিষ্যতে তেলের চাহিদা কমে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। তাই দেশগুলোর উচিত বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।’

ডেনমার্ক সম্প্রতি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি ঘোষণা করেছে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু ক্রমপরিকল্পনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রচুর বাতাস ও নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর নির্ভরশীল নর্ডিক দেশটি ২০৩৫ সালের মধ্যে ১৯৯০ সালের তুলনায় অন্তত ৮২ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকার করেছে। এটি যুক্তরাজ্যের ৮১ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রাকে অতিক্রম করবে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬৬.৩–৭২.৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। যদিও বহু উন্নত দেশ এরই মধ্যেই মধ্যশতাব্দীর মধ্যে নেট–জিরো লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে ২০৪০–৫০-এর দিকে দূষণ মাত্রাতিরিক্ত আকার ধারণ করবে, তখন নেট-জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হয়ে যাবে। তবে ইউরোপে গ্রিন নীতিমালা ও জলবায়ু আইনগুলোকে রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বন উজাড় রোধ এবং কোম্পানিগুলোর জাস্ট ট্রানজিশন পরিকল্পনা বাধ্যতামূলক করার আইন শিথিল করেছে। এর পেছনে রয়েছে সেন্টার-রাইট পার্টি ও ফার-রাইটের অপ্রত্যাশিত সমর্থনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক জটিলতা। এই পদক্ষেপ ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপীয় সবকেন্দ্রিক দলগুলোকে প্রভাবহীন করেছে। এর মাঝেও ইউরোপ জলবায়ু লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন লক্ষ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০৪০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমানো হবে, যদিও ৫ শতাংশ হ্রাস বিদেশি কার্বন ক্রেডিট থেকে আনা যেতে পারে। এতে প্রমাণিত হয় যে, মধ্যমেয়াদে এবং ছোট পদক্ষেপের পাশাপাশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য ও সেটি বাস্তবায়নের রোডম্যাপই বৈশ্বিক জলবায়ু কার্যক্রমে মূল চ্যালেঞ্জ ও অগ্রগতি নির্ধারণ করছে।

অপরদিকে, চীনের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ওয়াং ই জানিয়েছেন, চীন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি পরিবর্তনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে চীন একাই নেতৃত্ব দিতে চায় না। তিনি বলেন, ‘চীন ভুক্তভোগী দেশগুলোর জন্য আরও আর্থিক সহায়তা দেবে। তবে দেশটির লক্ষ্য হলো অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমন্বয়ে লো-কার্বন বা গ্রিন ট্রানজিশন এগিয়ে নেওয়া।’ ওয়াং জানিয়েছেন যে, চীন কার্বন নির্গমন কমাতে ধীরে হলেও স্থিতিশীল অগ্রগতি করেছে ও ভবিষ্যতেও করবে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি, গ্রিন হাইড্রোজেন, গ্রিন অ্যামোনিয়া, বৈদ্যুতিক যানবাহন ও নতুন বিদ্যুৎগ্রিডের মাধ্যমে সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের গ্রিন ট্রানজিশন নিশ্চিত করছে।

ওয়াং বলেন, ‘দেশগুলোর ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির কারণে একক ও অভিন্ন পথনির্দেশিকা প্রয়োগ করা কঠিন। প্রতিটি দেশের নিজস্ব রূপান্তর নীতি এবং রোডম্যাপ থাকা উচিত।’ তিনি ইউরোপ ও অন্যান্য সমৃদ্ধ দেশগুলোকে ধনী দেশগুলোর জন্য ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের প্রতি কঠোর শুল্ক আরোপ করে এবং ট্রেড বাধার কারণে বিকল্প প্রযুক্তি বিস্তারে সমস্যা সৃষ্টি করেছে।’

বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় চীনের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কপ৩০–এ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা বৈশ্বিক জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমানোর রোডম্যাপ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। এছাড়া, চীনের সঙ্গে তেলনির্ভর দেশগুলো এবং রাশিয়া, সৌদি আরব, বলিভিয়ার মতো দেশগুলোর সমন্বয়ে না থাকা বৈশ্বিক কূটনীতি সম্ভাব্য প্রতিরোধ চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে বলেও মতামত দেন ওয়াং।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম
বিজ্ঞাপন

আরো

উজ্জল জিসান - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর