ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো থেকে: জাতিসংঘের কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলন চূড়ান্ত দিনে এসেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেনি স্টেক হোল্ডাররা। কারণ, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার প্রস্তাবিত রোডম্যাপ নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে তীব্র অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অতিরিক্ত সময়ে গড়িয়েছে জলবায়ু সম্মেলন। এমনকি এদিন সমাপনী বৈঠকের সময়ও নির্ধারিত হয়নি। ১০ নভেম্বর শুরু হওয়া বেলেমের এই সম্মেলন ২১ নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতাই হয়নি।
পানামার বিশেষ জলবায়ু দূত হুয়ান কার্লোস গোমেজ জানান, চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বৈঠকে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন দেশগুলো পৃথকভাবে কপ৩০ সভাপতির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কড়া নিরাপত্তায় ঘেরা আলোচনা কক্ষে উপস্থিত এক আলোচক বলেন, ‘এখানে এখন প্রচণ্ড লড়াই চলছে। কথা ছিল স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার পর সম্মেলন শেষ হবে।’ কিন্তু তা পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। বেলেমে পর্যাপ্ত থাকার ব্যবস্থার অভাবে বহু দেশের প্রতিনিধিদল যে ক্রুজশিপে উঠেছেন তা শনিবার ছেড়ে যাবে— এটিও চাপে ফেলছে আলোচকদের।
রোডম্যাপ ছাড়া খসড়া, ক্ষুব্ধ বহু দেশ
২১ নভেম্বর প্রকাশিত সম্মেলনের খসড়া সিদ্ধান্তে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে যাওয়ার কোনো উল্লেখ না থাকায় বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বহু দেশ। এর আগেই ৮০টির বেশি দেশ কপ৩০ সিদ্ধান্তে জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগের রোডম্যাপ অন্তর্ভুক্তের দাবি জানিয়েছিল।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য বাস আইকহাউট খসড়াটিকে ‘ব্রিকসধর্মী পাঠ্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘এতে সৌদি আরব খুশি, চীন ও ভারতও মানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু ইউরোপের জন্য এটি গ্রহণযোগ্য নয়।’ আইকহাউটের মতে, দুর্বল এই পাঠ্য থাকলে ‘খারাপ চুক্তির চেয়ে কোনো চুক্তি না হওয়াই ভালো।’ ফ্রান্সের পরিবেশমন্ত্রী মোনিক বারবুট ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘রাশিয়া, ভারত, সৌদি আরবসহ তেল উৎপাদক দেশগুলো চুক্তি আটকে রেখেছে। এখন আমাদের হাতে কিছুই নেই।’
জীবাশ্ম জ্বালানির ধারা খসড়া থেকে উধাও, বাড়ছে ক্ষোভ
দুবাইয়ের কপ২৮–এ দুই বছর আগে দেশগুলো ‘জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণে’ ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ব্রাজিলে প্রথম খসড়ায় তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছিল— কখন এবং কীভাবে ধাপে ধাপে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমানো হবে। কিন্তু সর্বশেষ খসড়ায় সেসব পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে।
লুলার প্রতিশ্রুতি ও অনুপস্থিতি
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা সম্মেলনের আগে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কাটানোর আহ্বান জানিয়ে প্রত্যাশা বাড়ালেও বর্তমানে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় জি-২০ শীর্ষ বৈঠকে রয়েছেন। আইকহাউট মনে করেন, ‘লুলা বাজি বাড়িয়েছেন, এখন তা বাস্তবায়ন তার ওপরই নির্ভর করছে।’
অভিযোজন অর্থায়নই উন্নয়নশীল দেশের ‘রেডলাইন’
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র (সিডস) ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) অভিযোজন অর্থায়ন তিন গুণ বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ১২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার দাবি তুলেছে। তাদের মতে, জলবায়ুর ক্ষতি ঠেকাতে অভিযোজন অর্থায়ন ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যারা সবচেয়ে বড় জলবায়ু অর্থায়ন দাতা, তারা আলোচনায় বসতে আগ্রহ দেখালেও শর্ত দিয়েছে। কপ৩০ সিদ্ধান্তে নির্গমন কমানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট থাকতে হবে। যুক্তরাজ্যের এনার্জি সিকিউরিটি ও নেট জিরোবিষয়ক মন্ত্রী এড মিলিব্যান্ড বলেন, ‘এটা কঠিন, গরম, বিরক্তিকর। কিন্তু ৮০টির বেশি দেশের সমর্থিত জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তরণের রোডম্যাপ—এটা আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ১০–২০ বছর পরে মানুষ প্রশ্ন করবে— আপনারা তখন কী করেছিলেন ‘
জীবাশ্ম জ্বালানি বনাম অর্থায়ন—বিভক্ত বিশ্ব
ইইউ, যুক্তরাজ্য, লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ ও সিডস রোডম্যাপের পক্ষে থাকলেও বড় তেল ও গ্যাস উৎপাদক দেশগুলো বিষয়টি আটকে রাখতে চাইছে। তারা আলোচনাকে নির্গমন কমানো ও অভিযোজন অর্থায়নের পারস্পরিক ‘সমঝোতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। তারপরও মিলিব্যান্ড আশাবাদী ‘১৯৩টি দেশকে কাজ করে একসঙ্গে এগোতে হবে— এটাই আজ বিশ্বের প্রতি বার্তা।’
অর্থায়ন না পেলে সমর্থন নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাপ
জীবাশ্ম জ্বালানি হ্রাসের চুক্তিকে সমর্থন দিতে অনেক উন্নয়নশীল দেশ শর্ত হিসেবে অভিযোজন ও ক্ষতিপূরণ অর্থায়ন চায়। পাকিস্তানের প্রতিনিধি আইশা মরিয়ানা বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যেই নিঃসরণ কমাতে অনেক কাজ করেছি। এখন প্রয়োজন অভিযোজনের টাকা। কে দেবে এই অর্থ?’ তিনি স্পষ্টভাবে জানান, কয়েক ঘণ্টায় এমন বড় কোনো আর্থিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব নয়।
মাঠে উত্তেজনা, কর্মীদের স্লোগান ‘ফসিল ফুয়েল আউট’
সম্মেলন হলের বাইরে যুব জলবায়ু আন্দোলনকারীরা ব্যানার টানিয়েছেন—‘Stop Amazon Oil’, ‘1.5°C Under Threat’.
বিতর্কিত বাণিজ্য ভাষ্য, দুর্বল বনরক্ষা প্রতিশ্রুতি
নতুন খসড়ায় অভিযোজন অর্থায়ন তিনগুণ করার আহ্বান থাকলেও অর্থ কোথা থেকে আসবে তা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে খুশি নয় দরিদ্র দেশগুলো। এছাড়া, বন রক্ষায় ভাষা দুর্বল হওয়ার সমালোচনা করেছেন বহু পরিবেশবাদী। অ্যামাজন অঞ্চলের বন উজাড় মোকাবিলায় শক্ত অবস্থান আশা করেছিল তারা।
বিক্ষোভ, আগুন, নিরাপত্তা— ঝুঁকির মধ্যেই কপ৩০
গত দুই সপ্তাহে দু’বার সম্মেলনস্থল খালি করা হয়— একটি বিক্ষোভের কারণে, আরেকটি আগুন লাগার ঘটনায়। যেখানে ১৩ জন ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়। সব মিলিয়ে কপ৩০ চলছে উত্তেজনা, রাজনৈতিক চাপ ও নিরাপত্তা উদ্বেগের মধ্যে।
শেষ প্রশ্ন— চুক্তি আদৌ হবে কি?
১৯৪ দেশের সর্বসম্মতির প্রয়োজন। তেল উৎপাদক দেশগুলোর কঠোর অবস্থান এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থায়ন দাবি— এই দুই চাপের মাঝে সম্মেলনের ভাগ্য ঝুলে আছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলন কি আবারও সময় বাড়িয়ে কোনো মধ্যপথ খুঁজে পাবে, নাকি কপ৩০ ভেঙে পড়বে?— এই প্রশ্নই এখন বেলেমের আকাশে ভাসছে।