Sunday 23 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যোগ্যতা না থাকলেও জয়-তাজুলের প্রভাবে ‘নিবন্ধনধারী’ চিকিৎসক সুমনা!

মেহেদী হাসান স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৩ নভেম্বর ২০২৫ ২২:৪১

জয়-তাজুলের প্রভাবে বিএমডিসির ‘নিবন্ধন’ পান চিকিৎসক সুমনা। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: বিদেশি যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিগ্রি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) কর্তৃক স্বীকৃত নয়, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারী কোনো ব্যক্তিকে চিকিৎসক হিসেবে নিবন্ধন দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এবার সেই সুযোগ দিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে সংস্থাটি। প্রভাবশালীদের সুপারিশে বিদেশি অস্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়াদের এমবিবিএস নিবন্ধন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিএমডিসির বিরুদ্ধে। আইনের বাইরে সংস্থাটির নিবন্ধন পাওয়া এমন একজন হলেন- ডা. সুমনা ইসলাম।

সুমনা বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২০০৬ সালে এসএসসি এবং ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। এর পর রাশিয়ায় অবস্থিত ‘পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি’ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ‘ডক্টর অব মেডিসিন’- এ ২০১৮ সালে ডিপ্লোমা পাস করেন সুমনা ইসলাম। তার পর বাংলাদেশে ফিরে ‘বিশেষ সুপারিশে’ বিএমডিসি নিবন্ধন পরীক্ষা দেন সুমনা। এই পরীক্ষার সুবাদে ২০২০ সালে বিএমডিসি’র নিবন্ধনভুক্ত হন সুমনা ইসলাম। কিন্তু নিয়মবহির্ভূতভাবে তাকে বিএমডিসি’র চিকিৎসক নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০ এবং ২০২০ অনুযায়ী, বাংলাদেশের বাইরে অবস্থিত কোনো মেডিকেল প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত মেডিকেল চিকিৎসা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি বা ডিপ্লোমাধারী কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশে ওই ডিগ্রি ব্যবহার করতে চাইলে, তা এই আইনের অধীন কাউন্সিল কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাশিয়ায় ডা. সুমনা ইসলামের ‘ডক্টর অব মেডিসিন’ ডিগ্রি বিএমডিসি স্বীকৃত নয়। রাশিয়ায় ‘ডক্টর অব মেডিসিন’ ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে ওই দেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বীকৃতি দেয় বিএমডিসি। বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি হলো- রাশিয়ান স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি অব মস্কো, ফ্যাকালটি অব মেডিসিন; লমোনসভা মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি, ফ্যাকালটি অব মেডিসিন এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটি, ফ্যাকালটি অব মেডিসিন। কিন্তু এর মধ্যে রাশিয়ার ‘পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি’এর নাম নেই। এছাড়া, রাশিয়ার যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ব্যাচেলর অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারি’ ডিগ্রিধারী বিএমডিসি’র নিবন্ধনভুক্ত চিকিৎসক হতে পারবেন। এ থেকে বোঝা যায়, রাশিয়া থেকে অর্জিত সুমনা ইসলামের ডিগ্রি বিএমডিসি’র আইন অনুসরণ করেনি।

সূত্র মতে, রাশিয়া থেকে ফেরার পর থেকেই নিজের নামের সঙ্গে ‘ডাক্তার’ পদবি ব্যবহার করেন সুমনা, যা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতেও দেখা গেছে। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ দেওয়ার আদেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর পর পারিবারিক সমস্যার কারণ দেখিয়ে সুমনা ইন্টার্নশিপ নেন পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ২০১৯ সালের ২১ মার্চ তার ইন্টারর্নশিপের আদেশ জারি করে। আর ২০২০ সালে এমবিবিএস চিকিৎসক হিসেবে বিএমডিসি সুমনা ইসলামকে নিবন্ধনভুক্ত করে। যার মেয়াদ ২০৩০ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত।

এদিকে বিএমডিসি আইন অনুযায়ী, ‘পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি’ থেকে ‘ডক্টর অব মেডিসিন’ ডিগ্রি বিএমডিসি স্বীকৃত না এবং তফসিলের অন্তর্ভুক্ত নয়। এই ডিগ্রিকে ‘এমবিবিএস’র সমমান দেখানো বা রাজনৈতিক প্রভাবে ইন্টার্নশিপে অংশ নেওয়া বিএমডিসি আইন ২০২০ এর ২২, ২৭, ২৭ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানারও বিধান রয়েছে।

স্বীকৃত না হয়েও এমবিবিএস নিবন্ধন পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. মো. লিয়াকত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের নিয়মটা কি? ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করলে এলিজিবল টু অ্যাপ্লাই। অ্যাপ্লিকেশন একসেপ্ট হলে পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দেবে। পরীক্ষায় পাস করলে ডিজি অফিস থেকে ইন্টার্নশিপটা নির্ধারণ করে দেয়, কে কোথায় করবে। আমাদের কাজ হলো ইন্টার্নশিপ প্লেসমেন্ট নেওয়া। আর ইন্টার্নশিপ যদি কমপ্লিট না করে, তাহলে তো সে রেজিস্ট্রেশনই পাবে না। আর ইন্টার্নশিপ করে এসে যদি আমাদের কাছে কাগজপত্র সাবমিট করে তাহলে তো আমরা নিবন্ধন দেব। বিএমডিসিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যেভাবে নির্দেশনা দেয় সেভাবে কাজ করে। সে সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবেই কাজ করেছে বিএমডিসি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমডিসি’র এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়ার বিশ্ববিদালয়ে কেউ পড়াশোনা করলে সেটি ওই দেশের কাউন্সিলভুক্ত কিনা সেটি দেখতে হবে। কাউন্সিলভুক্ত হলে তিনি বিএমডিসিতে আবেদন করতে পারবেন। আর তিনি আবেদন করার পর বিএমডিসি থেকে গঠিত কাউন্সিলভুক্ত যদি মনে করে সমস্যা নাই, তাহলে বিএমডিসি নিবন্ধনভুক্ত হতে পারবেন। সুমনা ইসলামের ক্ষেত্রেও হয়তো এমনটাই হয়েছে।’

কাউন্সিল-ই যদি পরবর্তী সময়ে এমন সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তো বিদেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এসে ‘বিশেষ সুপারিশ’ বা অন্য কোনো উপায়ে যে কেউ বিএমডিসি’র নিবন্ধন পাবেন। এর মানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিএমডিসি আইন, বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিগ্রি স্বীকৃতি দেওয়া কোনো নাটকীয়তা কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিএমডিসি যেটা রয়েছে, সেটা যদি পুরোপুরি কঠোরভাবে মানা হয়, তাহলে তো বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে কেউ নিবন্ধন পাবে না। কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা স্বীকৃত হিসেবে বিএমডিসি আইনে দেওয়া হয়নি।’

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তানভীর শাকিল জয়ের বন্ধু ছিলেন ডা. সুমনা ইসলাম। চিকিৎসক নিবন্ধন পেতে সেই প্রভাব খাটিয়েই তিনি যাচাই-বাছাই এড়িয়ে সুবিধা পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি, সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এবং কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার বান্ধবী তিনি। আর এসব প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা ভাগিয়ে নিতেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

সূত্র জানায়, কেউ একবার, দুইবার বা তিনবারেও পাস মার্ক অর্জন করতে না পারলে, তখন কেউ কেউ অন্য কোনো পন্থায় মেকানিজম করে ডিজি অফিসে একটা লাইনআপের মাধ্যমে ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করে। আর সেই ইন্টার্নশিপের সুবাদের বিএমডিসি থেকে পেয়ে যান চিকিৎসক নিবন্ধন।

বিএমডিসি কর্তৃক দেওয়া নিবন্ধনের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. রোকসানা আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশে পড়াশোনা করে সরাসরি বিএমডিসি নিবন্ধনভুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তবে যারা বিদেশ থেকে এসে বাংলাদেশে বিএমডিসিতে নিবন্ধন করতে চান, তাদের দেশে একটা পরীক্ষা দিতে-ই হবে এবং এটা অত্যাবশকীয়। এই পরীক্ষায় যারা পাস করবে তাদের বাংলাদেশে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে সেটি বিএমডিসি স্বীকৃত বা অধীভুক্তও হতে হবে। বিশ্বে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সব তো আর বিএমডিসি স্বীকৃত না।’

জানা গেছে, রাশিয়ায় থাকার সময় সুমনা ইসলাম রাশিয়া ইউনিট ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন এবং বর্তমানে তিনি ধানমন্ডি মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য। সুমনার বাড়ি পিরোজপুরের ইন্দুরকান্দি উপজেলার নলবুনিয়া গ্রামে। তিনি ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামাতো বোন। এছাড়া, বর্তমানে ধানমন্ডি মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং জুলাই আন্দোলনে রাজধানী ঢাকায় তার বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা রয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডা. সুমনা ইসলামের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করে এবং এসএমএস পাঠিয়েও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে চিকিৎসকরা বলেন, স্বীকৃত নয় এমন প্রতিষ্ঠান থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করা ব্যক্তিদের চিকিৎসা পেশায় যুক্ত হওয়া রোগীর নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি। এ ধরনের অনিয়ম পুরো চিকিৎসা পেশার মর্যাদা নষ্ট করে। কিছু মানুষ যদি ক্ষমতার জোরে নিবন্ধন পায়, এটি ঠিক না। রোগীর জীবন নিয়ে কাজ, এখানে কোনো আপস চলবে না। নিবন্ধন নিয়ে যদি রাজনৈতিক বা আর্থিক প্রভাব খাটানো হয়, তা জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তার ওপর বড় হুমকি তৈরি করবে।

বিগত সময়েও ভুয়া সনদে অনেকেই বিএমডিসি’র নিবন্ধনভুক্ত চিকিৎসক হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮ জনের অধিক ভুয়া ও জাল সনদধারীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় পরে মামলাও করেছিল বিএমডিসি।

সুমনা ইসলামকে বিএমডিসি নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়ে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) মহাসচিব ডা. মো. জহিরুল ইসলাম শাকিল সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে এবং অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই এর প্রতিবাদ করব, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না হয়। সেই সঙ্গে এটা যেন বাতিল করা হয় সে জন্য আমরা দাবি জানাব। আর বিএমডিসি’র যে নীতিমালা আছে সেটি বাস্তবায়ন করার দাবি জানাব।’

নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রায়ই বিএমডিসি কর্তৃক চিকিৎসক নিবন্ধনের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ ভুয়া ডিগ্রি নিয়ে এসে নিবন্ধন পেলে স্বাস্থ্যখাতে এর প্রভাব পড়বে। বিএমডিসি’র যে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আছে সেটি আরও কঠোরভাবে দেখা দরকার। কেউ যাতে ভুয়া ডিগ্রি নিয়ে ও ভুয়া কলেজ থেকে এসে নিবন্ধন না পায় সে বিষয়ে আমরা সোচ্চার।’

বিজ্ঞাপন

এভারকেয়ারে ভর্তি খালেদা জিয়া
২৩ নভেম্বর ২০২৫ ২১:১৮

আরো

মেহেদী হাসান - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর