Sunday 23 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ কপ৩০, জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে হতাশ বিশ্ব

উজ্জল জিসান স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৩ নভেম্বর ২০২৫ ২৩:৫২ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৫ ০০:১৪

কপ৩০ সম্মেলন। ছবি: সংগৃহীত

সাওপাওলো, ব্রাজিল থেকে: জীবাশ্ম জ্বালানি ইস্যুতে কার্যত কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলন। জলবায়ু সংকটের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমায় রাখতে বিশ্বের তীব্র আহ্বান সত্ত্বেও কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে সরে আসার বিষয়ে চূড়ান্ত নথিতে কোনো কিছু রাখা হয়নি। ফলে সম্মেলনের সবচেয়ে প্রত্যাশিত বিষয়ে স্পষ্ট অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে বহু দেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে, গতবছর বাকু সম্মেলনে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঘোষণা শেষ পর্যায়ে এসে প্রাণ পেলেও, এবার ফান্ডের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বিলিয়ন তো দূরের কথা মাত্র কয়েক মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে কয়েকটি দেশের কাছ থেকে। সম্মেলনের সভাপতি আন্দ্রে করেয়া দো লাগো স্বীকার করেছেন, ‘অনেক দেশ আরও উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত আশা করেছিল। ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ৮০টির বেশি দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার পূর্ব প্রতিশ্রুতি এগিয়ে নিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হয়।’

বিজ্ঞাপন

তবে তিনি বলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমানো এবং বন উজাড় হ্রাসে দু’টি পৃথক রোডম্যাপ তৈরি করা হবে। তবে এই রোডম্যাপ কপ-এর আনুষ্ঠানিক আলোচনার ভেতরে নয়, বরং বাইরে স্বেচ্ছা প্রক্রিয়ায় তৈরি হবে। দেশ ও সংস্থাগুলো এতে মতামত দিতে পারবে। কিন্তু, কোনো বাধ্যতামূলক নীতি বা আইনি কাঠামো যুক্ত হবে না। রোডম্যাপের অগ্রগতি জানানো হবে আগামী বছর তুরস্কে অনুষ্ঠিতব্য কপ৩১ সম্মেলনে।’

জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু সংকটের জরুরি বাস্তবতায় এই ধরনের স্বেচ্ছামূলক পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। তারা মনে করেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো ছাড়া কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়। জলবায়ু-বিপন্ন ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বলছে, ‘কোনো নতুন পদক্ষেপ নেই, কোনো রোডম্যাপ নেই’— এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবে কোনো পরিবর্তন আনবে না।

৮০ দেশের দাবি উপেক্ষিত

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ, দ্বীপরাষ্ট্র এবং স্বল্পোন্নত দেশসহ অন্তত ৮০টি দেশ দাবি তোলে— চূড়ান্ত নথিতে জীবাশ্ম জ্বালানি ট্রানজিশনের ভাষা যুক্ত করতে হবে। তাদের যুক্তি ছিল, জলবায়ু সংকটের মূল কারণ মোকাবিলা ছাড়া কপ সম্মেলনের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তব প্রভাব ফেলবে না। তবে শেষ সময়ে সৌদি আরব, রাশিয়া ও অন্যান্য প্রধান তেল উৎপাদক দেশগুলোর তীব্র বিরোধিতার মুখে সেই দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। নাইজেরিয়া বলে, জোরপূর্বক কোনো রূপান্তর অর্থনীতির ওপর বড় ধাক্কা তৈরি করবে এবং তা সফল হতে পারে না।

শেষ দিনের আলোচনায় তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। বিশেষ করে কলম্বিয়া অতিরিক্ত ভাষা ও কঠোর অবস্থান যুক্ত করার দাবি তোলে। তাদের দৃঢ় অবস্থানের পর এক পর্যায়ে চূড়ান্ত বৈঠক সাময়িকভাবে স্থগিতও হয়। পরে সভাপতি দো লাগো আশ্বাস দেন যে, ছয় মাস পরে বিষয়টি আবার আলোচনায় আনা যাবে।

চূড়ান্ত নথিতে জীবাশ্ম জ্বালানি উল্লেখ না থাকলেও দুটি নতুন উদ্যোগ ঘোষণা করা হয়- গ্লোবাল ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যাক্সেলারেটর ও বেলেম মিশন টু ১.৫°C। এই কর্মসূচির লক্ষ্য দেশগুলোর জলবায়ু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করা এবং প্যারিস চুক্তির ১.৫ ডিগ্রি সীমা ধরে রাখা। তবে এখানেও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো বা বন্ধ করার নির্দেশনা নেই। নথিতে বলা হয়— ‘নিম্ন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ও জলবায়ু সহনশীল উন্নয়নের পথে বৈশ্বিক রূপান্তর অপরিবর্তনীয়।’ বিশেষজ্ঞরা এই বক্তব্যকে রাজনৈতিক সংকেত হিসেবে দেখছেন, তবে বাস্তব পদক্ষেপ হিসেবে নয়।

সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোজন অর্থায়ন বাড়ানোর দাবি তোলে। সিদ্ধান্তে বলা হয়, ২০৩৫ সালের মধ্যে অভিযোজন অর্থায়ন অন্তত তিনগুণ বাড়াতে হবে। কপ২৯-এ ধনী দেশগুলো বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও স্বল্পোন্নত দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যেই ১২০ বিলিয়ন ডলারের দাবি জানায়। সেই দাবি পূরণ হয়নি। এলডিসি গ্রুপ জানায়, তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল পাওয়া যায়নি এবং কপ৩১ ও কপ৩২-এ তারা আরও জোরালো ভূমিকা নেবে।

চূড়ান্ত নথিতে বলা হয়, জলবায়ু পদক্ষেপের নামে কোনো বৈষম্যমূলক বা গোপন বাণিজ্য বাধা আরোপ করা যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্বন সীমান্ত কর নিয়ে যেসব দেশ উদ্বেগ জানিয়েছিল, তারা এই অবস্থানকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিয়েল বলেন, ‘ঝোড়ো রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেও ১৯৪টি দেশ সহযোগিতা ধরে রেখেছে।’ তবে বাস্তবতা হলো, বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু জীবাশ্ম জ্বালানি কমানো নিয়ে কপ৩০ কোনো দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে নজর এখন কপ৩১-এর দিকে, যেখানে রোডম্যাপের প্রথম অগ্রগতি প্রকাশ পাওয়ার কথা।

অ্যামাজনের শিক্ষা

অ্যামাজন, যেখানে জলবায়ু সংকটের ভয়াবহ প্রভাব স্পষ্ট, সেখানেই এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া বিশেষ প্রতীকী। বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যামাজন সংকটে থাকলেও সমাধানের উৎসও একই অঞ্চল। তবে কপ৩০-এর বাস্তব ফল বলছে, সম্মেলন শেষ হলেও জলবায়ু সংগ্রাম এখনো অনেক দূর। দৃঢ় সিদ্ধান্ত ছাড়া পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা সম্ভব নয়।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ স্টিল বলেন, ‘কপ৩০ প্রমাণ করেছে যে, বৈশ্বিক জলবায়ু সহযোগিতা এখনো ‘জীবিত ও সক্রিয়’ এবং মানবজাতি এখনো লড়াইয়ে আছে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রক্ষার জন্য।’ শনিবার (২২ নভেম্বর) বেলেমে সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ‘২০২৫ সাল ছিল তীব্র রাজনৈতিক বিভাজন, অস্বীকার আর ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার সময়। তার পরও কপ৩০ দেখিয়েছে— একতা, বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা জয় পেয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা হয়তো বলছি না যে, জলবায়ু যুদ্ধে জিতে গেছি। কিন্তু আমরা এখনো লড়াইয়ে আছি এবং পাল্টা লড়াই চালাচ্ছি।’ তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৪টি দেশ এক কণ্ঠে জানিয়েছে ‘প্যারিস চুক্তি কার্যকরী’ এবং এটিকে আরও দ্রুত ও দূর পর্যন্ত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দেশগুলো প্রথমবারের মতো সম্মিলিতভাবে ঘোষণা করেছে যে, কম-কার্বন ও জলবায়ু-সহনশীল বিশ্ব অর্থনীতির দিকে বৈশ্বিক রূপান্তর ‘অপরিবর্তনীয়’ এবং এটাই ভবিষ্যতের পথ।

স্টিল জানান, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ এখন জীবাশ্ম জ্বালানির বিপুল পরিমাণ অতিক্রম করছে, যা বিশ্ববাজারে স্পষ্ট রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকেত তৈরি করেছে। তার বক্তব্যে কপ৩০–এর কয়েকটি বড় অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। ন্যায়সঙ্গত জ্বালানি রূপান্তরের নতুন চুক্তি, যাতে প্রতিটি দেশ ও মানুষ সমানভাবে উপকৃত হতে পারে অ্যাডাপটেশন ফাইন্যান্স তিনগুণ বৃদ্ধি, যাতে জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো সহায়তা পায়।

স্টিল বলেন, ‘এগুলো কোনো আনুষ্ঠানিক সাইড-শো নয়, এগুলো বাস্তব অগ্রগতি, যা সরাসরি মানুষের খাদ্য, জ্বালানি ব্যয়, বায়ুদূষণ ও নিরাপত্তার মতো জীবনের জরুরি প্রশ্নগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত।’ তিনি সতর্ক করেন যে, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যখন অর্থনীতি ও সমাজে চাপ বাড়াচ্ছে, তখন ভুয়া তথ্য সেই ভয়ের সুযোগ নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। সব কিছুর দোষ দেওয়া হচ্ছে, শুধু প্রকৃত কারণ ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ ছাড়া।”

বহু দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি, অর্থায়ন ও দুর্যোগ প্রতিক্রিয়ায় আরও দ্রুত পদক্ষেপ চাইছে উল্লেখ করে স্টিল বলেন, ‘হতাশা থাকলেও কপ৩০ সামনে এগিয়ে দিয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ু প্রক্রিয়াকে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সহনশীলতার পথে অগ্রযাত্রা আর থামবে না।’

শেষে তিনি ব্রাজিল, সম্মেলন সভাপতি ও অংশীদেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “কপ৩০–এ দেখা ‘সমষ্টিগত প্রচেষ্টার চেতনা’ যা স্থানীয় ভাষায় ‘মুতিরাঁও’— আগামী দিনেও বিশ্বকে এগিয়ে নেবে।”

বিজ্ঞাপন

আরো

উজ্জল জিসান - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর