রংপুর: রংপুর অঞ্চলে আমন ধানের কাটাই–মাড়াই এখন পুরোদমে চলছে। মাঠজুড়ে বাম্পার ফলনে গোলা ভরছে নতুন ধানে। কিন্তু বাজারে ধানের দাম হু-হু করে কমার ফলে কৃষকের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। গত বছরের তুলনায় প্রতি মণে ১৫০–২০০ টাকা কম দরে আমন বিক্রি হওয়ায় কৃষকদের সামনে লোকসানের আশঙ্কা ঘনিয়ে উঠছে। লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে বাম্পার উৎপাদন সত্ত্বেও দাম কমার কারণে কৃষকরা আশঙ্কায় আছেন; পুরোদমে ফসল তোলা শুরু হলে দাম আরও কমতে পারে।

ধান মাড়াইয়ে ব্যস্ত কৃষক
মাঠপর্যায়ে দেখা গেছে, আমন মৌসুমের শুরুতে গত বছর যেখানে প্রতি মণ ধান ১ হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, মৌসুমের শেষে সেটি দাঁড়ায় ১ হাজার ৪০০ টাকায়। কিন্তু এ বছর শুরুতেই দাম নেমে এসেছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়। কৃষকদের আশঙ্কা—ফসল তোলা বাড়লে দাম আরও কমে হাজার টাকার নিচে নেমে যেতে পারে।
রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার কৃষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ফসল ভালো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দাম যদি কমে যায় তাহলে খরচই উঠবে না। এত পরিশ্রম করে যদি লোকসান গুনতে হয়, তবে কৃষি টেকানো কঠিন হয়ে যাবে।’ একই সুর টিপু সুলতানসহ অনেক কৃষকের কণ্ঠেও—ফসল ভালো, কিন্তু বাজার খারাপ।
নগরের মাহিগঞ্জ এলাকার চাল–ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত করেছেন, বাজারে আমনের দাম গত বছরের তুলনায় ১৫০–২০০ টাকা কম। যদিও তারা আশা করছেন, কয়েক দিনের মধ্যে চাহিদা বাড়লে দাম কিছুটা স্থিতিশীল হতে পারে।
জাতীয় পর্যায়ে আমন ধানের বাজারও অস্থির। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে দাম ১ হাজার ৩৩০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে, যা গত মৌসুমের তুলনায় কম। অতিরিক্ত সরবরাহ এবং চালের পুরোনো স্টকের প্রভাবে এই অবনতি ঘটেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এদিকে অনুকূল আবহাওয়া এবং বাড়তি আবাদের ফলে রংপুরে আমন ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এবার আবাদের লক্ষ্য ছিল ৬ লাখ ২০ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে, কিন্তু বাস্তবে ৬ লাখ ২১ হাজার ৫০০ হেক্টরে আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে উৎপাদনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে ২০ লাখ ১০ হাজার টনেরও বেশি। গড়ে প্রতি হেক্টরে ৩.২৫ টন পরিষ্কার চাল (৪.৮৭৫ টন ধান) উৎপাদিত হচ্ছে, যা কৃষকদের গোলা ভরিয়ে তুলেছে।
গত ১০ বছরে এই অঞ্চলে আমন ধানের আবাদ ৩৭ হাজার হেক্টরেরও বেশি বেড়েছে, উৎপাদন ৬ লাখ মেট্রিক টন অতিক্রম করেছে। জাতীয়ভাবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমন মৌসুমে ১.৬৫ কোটি টন উৎপাদন হবে, যা গত বছরের তুলনায় সামান্য বেশি। রংপুরের পাঁচটি জেলায় প্রথমদিকের আমন ফসলের বিক্রয় থেকে কৃষকরা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
সরকার আমন ধানের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে কৃষকদের সুরক্ষা দিচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধানের কেজি প্রতি ৩৪ টাকা (প্রতি মণ ১ হাজার ৩৬০ টাকা) এবং আতব ধানের জন্য ৪৯ টাকা নির্ধারণ করেছে, যা গত বছরের তুলনায় ৭-১০ শতাংশ বেশি। পরোক্ষ চালের জন্য ৫০ টাকা দর ঠিক করা হয়েছে। ক্রয়কাল ১৭ নভেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। তবে আমন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা বাজারে সরবরাহের চাপ বাড়াতে পারে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, উৎপাদন মাত্রা বেশি তাই দামও বাড়বে এবং কৃষকদের লোকসানের শঙ্কা নেই। তিনি বলেন, সরকারের ক্রয় ব্যবস্থা এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দাম স্থিতিশীল হবে।
তবে কৃষকরা বলছেন, আলু চাষিদের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে উৎপাদন হলেও বাজারের দামহ্রাসে তারা লোকসান গুনছেন, যা আমন কৃষকদের জন্যও একটা বড় ধরণের সতর্কবার্তা।
এদিকে জাতীয় অর্থনীতির সংকট এবং অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে আমন বাজার চাপের মুখে। কৃষকরা দাবি করছেন, উৎপাদন খরচ বিবেচনা করে আরও সহায়ক নীতি প্রণয়ন করা উচিত।