বগুড়া: বগুড়ার হিমাগারগুলোতে এখনো বিপুল পরিমাণ আলু মজুদ রয়ে গেছে। বাজারে দাম কম থাকায় বিক্রিতে লোকসানের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবুও শঙ্কা মাথায় নিয়ে নতুন মৌসুমে আলু চাষে নেমে পড়েছেন চাষিরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ধান কাটার পরপরই কৃষকরা জমি প্রস্তুতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আগাম জাতের বীজ মাটিতে পড়তে শুরু করেছে অক্টোবরের শেষ থেকেই। গত বছরের লোকসান এখনো পুরোপুরি কাটেনি তবুও ঝুঁকি নিয়েই আলু চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। এবার তারা বেশি উৎপাদনশীল জাতের আলু চাষের চেষ্টা করছেন এবং লাভজনক বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা করছেন।

বগুড়া আলুখেত প্রস্তুত করছেন চাষিরা। ছবি: সারাবাংলা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ায় গত মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন বেশি আলু উৎপাদন হয়েছিল। ফলন ভালো হলেও বাজারে তার প্রতিফলন আসেনি। দাম না পাওয়ায় কৃষকেরা হিমাগারে রেখেছিলেন আলুর বড় অংশ। এখনো প্রায় ৪০ শতাংশ আলু হিমাগারেই মজুত। জেলার ৪২টি হিমাগারে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করার সুযোগ থাকলেও বিপুল পরিমাণ আলু আটকে থাকায় বাজারে নতুন আলুর দামে প্রভাব পড়ছে। অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় দাম পড়ে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়েন কৃষকরা।
বর্তমানে খোলা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৮ থেকে ২৫ টাকায়—যেখানে গত মৌসুমে সংরক্ষণসহ মোট খরচ পড়েছিল কেজিপ্রতি ২৪ থেকে ২৬ টাকা। অর্থাৎ কৃষকের এখনও প্রতিকেজিতে লোকসানই গুনতে হচ্ছে।

আগাম জাতের আলু চাষে বীজ বপনে ব্যস্ত চাষিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, বগুড়ায় মোট ৪৮ জাতের আলুর চাষ হয়। এর মধ্যে উচ্চফলনশীল ‘এস্টারিক্স’ জাতই সবচেয়ে জনপ্রিয়। গত মৌসুমে ৫৫ হাজার ৬০ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আবাদ হয়েছিল ৬০ হাজার হেক্টরেরও বেশি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উৎপাদন পৌঁছেছিল প্রায় ১৩ লাখ মেট্রিক টনে। চলতি মৌসুমেও লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ এবং ১৩ লাখ ৩৫ হাজার টনেরও বেশি উৎপাদন। তবে হিমাগারে আগের বছরের আলু এখনও জমে থাকায় কৃষকের লাভের চেয়ে লোকসানের আশঙ্কা করছেন বেশি।
নন্দীগ্রামের আলাইপুর গ্রামের কৃষক সুশান্ত কুমার শান্ত বলেন, ‘চার বিঘা জমিতে আগাম সানসাইন জাতের আলু লাগিয়েছি। প্রতি বিঘায় ২৫ হাজার টাকা খরচ। গত বছর আলুর দাম না বাড়ায় লাভ তো দূরের কথা, মূলধনটাই তুলতে পারিনি। এবার বীজ, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি—সব কিছুর দাম বেড়েছে। ফলন শেষে যদি দাম না বাড়ে, আবারো লোকসানে পড়তে হবে।’
এমন অভিজ্ঞতা বগুড়ার প্রায় সব উপজেলাতেই। বীজ আলুর দাম বাড়ায় আবাদ খরচ বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। উৎপাদনের পর হিমাগারে রাখা, আবার সেখান থেকে বাজারজাত করা—সব মিলিয়ে কৃষকের খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম ফরিদ বলেন, ‘চলতি বছর লক্ষ্য ৫৫ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমি। কৃষকদের মাঠপর্যায়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বাম্পার ফলন হবে। আমরা আশা করি কৃষকেরা ভালো দামও পাবেন।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বগুড়ার কৃষকেরা দেশের অন্যতম প্রধান আলু উৎপাদক। কিন্তু গত বছরের অতিরিক্ত উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থাপনার সংকট ও মূল্যপতন তাদের আস্থায় বড় ধাক্কা দিয়েছে। তবুও তারা নতুন মৌসুমের দিকে তাকিয়ে আছে আশার চোখে—হয়তো এইবার দাম বাড়বে, হয়তো ক্ষতির হিসাব কিছুটা কমবে। কিন্তু উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনা কতটা শক্তিশালী হবে—কৃষকের ভবিষ্যৎ লাভ-লোকসান এখন সেই সমীকরণেই নির্ভর করছে।