Wednesday 26 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উন্নয়নের নামে শাহজালাল মাজারে খেজুরগাছ নিধন, ক্ষোভের ঝড়

জুলফিকার তাজুল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৭ নভেম্বর ২০২৫ ০১:০৬ | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৫ ০১:০৯

শাহজালাল মাজারে খেজুরগাছ নিধন। ছবি: সারাবাংলা

সিলেট: সিলেটের আকাশে আজ যেন অতিরিক্ত ভার—ধুলো নয়, মানুষের ব্যথা আর ক্ষোভের ভার। হযরত শাহজালাল (রহ.)–এর পবিত্র মাজার প্রাঙ্গণে ঢুকতেই সেই চিরচেনা শান্ত ও আধ্যাত্মিক আবহের সঙ্গে মিশে গেছে এক ধরনের নীরব শোক। পবিত্র মাজার প্রাঙ্গণে মিনারের পাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা খেজুরগাছগুলো আর নেই। সিলেটের পরিচয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ ছিল এই গাছগুলো। উন্নয়নের নামে কেটে ফেলা হয়েছে বহু বছরের স্মৃতিবাহী এসব গাছ। এই দৃশ্য দেখে শোকাহত শুধু পরিবেশবাদীরা নন, হতবাক ও ব্যথিত মাজারের ভক্তরাও।

অনেকেই বলছেন—গাছগুলো শুধু গাছ ছিল না, এগুলো ছিল মাজার প্রাঙ্গণের আত্মিক সৌন্দর্যের অংশ। “এদের ছায়ায় বসে কত মানুষ দোয়া করেছে, কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আজ হঠাৎ কেটে ফেলা হলো—মন ভেঙে যায়,” বলেন দীর্ঘদিন ধরে মাজারে আসা এক ভক্ত।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, মাজার মসজিদের উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে অস্থায়ী নামাজের স্থান তৈরির কথা বলে খেজুরসহ বেশ কয়েকটি পুরনো গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। মসজিদ কর্তৃপক্ষের দাবি—পুরোনো তিনতলা ভবন ভেঙে ছয়তলা মসজিদ নির্মাণের সময় অস্থায়ী টিনশেড মসজিদ নির্মাণ ছাড়া উপায় ছিল না।

কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন—আগেও গাছ রেখে সামিয়ানা দিয়ে অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছে। এবার কেন নয়? কেন হঠাৎ করে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত? তাদের মতে, গাছ কাটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক।

মাজার মসজিদ পরিচালনা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম এম সোহেল উদ্দিন আহমেদ জানান, বিষয়টি নিয়ে কমিটির ভেতর একাধিক বৈঠক হয়েছে। তাদের অবস্থান ছিল-গাছ যেন না কাটা হয়। “কিন্তু কোনভাবেই এগুলো রক্ষা করা গেল না,”-বললেন তিনি। “অস্থায়ী নির্মাণের জন্য কেন এই গাছগুলো কাটতেই হবে-এ নিয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আমরা পাইনি।”

এ ব্যাপারে শাহজালাল মাজার মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুফতি মোহাম্মদ হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন বক্তব্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।

তবে নিজের অপারগতার কথা জানালেন মাজারের একজন খাদেম নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনি বলেন—“আমরা চেষ্টা করেছি গাছ বাঁচাতে। কিন্তু যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা আমাদের অনুরোধ শুনলেন না। এটা আমাদের জন্যও কষ্টের।

গাছ কাটার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সিলেটে ক্ষোভ আরও তীব্র হয়। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো একে “বিবেকহীন সিদ্ধান্ত” উল্লেখ করে অভিযোগ তুলেছে—ঐতিহাসিক স্থানের প্রকৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষই পালন করেনি।

প্রকৃতি ও জীবন ক্লাবের সিলেট সমন্বয়ক সাদিকুর রহমান সাকী বলেন—“এই গাছগুলো শুধু সবুজ সৌন্দর্য ছিল না, এগুলো ছিল মাজারের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। উন্নয়ন অবশ্যই দরকার, কিন্তু উন্নয়ন মানে ঐতিহ্যকে হত্যা করা নয়। টিনশেড ঘর নির্মাণের জন্য এমন পুরনো খেজুরগাছ কাটা কখনোই যুক্তিসংগত নয়।”

তিনি আরও বলেন, “এগুলো বড় হতে লেগেছে বছরের পর বছর। কিন্তু কাটতে লেগেছে মাত্র কয়েক মিনিট। এই ক্ষতি ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ। ধর্মীয় স্থানের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করা দায়িত্বশীলদের প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত।”

পরিবেশবিদদের মতে, মাজারের মতো ঐতিহাসিক জায়গায় যেকোনো উন্নয়নকাজে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা উচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা স্পষ্টভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।

মাজারে আগত ভক্তরা বিষয়টি মানতে পারছেন না। এক বৃদ্ধ ভক্ত বলেন—“শাহজালাল মাজারে ঢুকলেই খেজুরগাছগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে মনে হতো—এই শহরের সব ইতিহাস যেন এখানে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সেগুলো নেই দেখে মনে হলো নিজের অতীতটাই যেন হারিয়ে ফেললাম।”

আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, “সিলেটের প্রতিটি মানুষেরই এই দৃশ্যের সাথে আবেগ জড়িত। এভাবে কাটার আগে জনগণের মতামত নেয়ার দরকার ছিল। উন্নয়ন মানে কি ঐতিহ্য মুছে ফেলা?”

নাগরিক সমাজ মনে করে, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তারা আশঙ্কা করছেন—এভাবে একের পর এক ঐতিহ্যবাহী স্থানে গাছ কাটা বা পরিবর্তনের নামে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকলে শহরের পরিচয়ই এক সময় মুছে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন ও ঐতিহ্যকে সমন্বয় করে এগোনোই সভ্যতার পথ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো ঐতিহ্য রক্ষা করেই উন্নয়ন করেছে। সিলেটেও সেই পথ অনুসরণ করা উচিত ছিল।

বিজ্ঞাপন

১৬৬ উপজেলায় ইউএনও পদে রদবদল
২৬ নভেম্বর ২০২৫ ২৩:৫২

আরো

সম্পর্কিত খবর