ঢাকা: চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ দেশের জন্য সুখবর হতে পারে, তবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে চুক্তিপ্রক্রিয়া ও শর্তাবলিসংক্রান্ত সকল তথ্য প্রকাশ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একইসঙ্গে বন্দরের কার্যকরিতা বৃদ্ধিতে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ ও পুরোনো টার্মিনালের অপারেটর নিয়োগের দৃশ্যত তড়িঘড়ি উদ্যোগসমূহ কী এড-হক ভিত্তিতে গৃহীত হচ্ছে, না-কী বন্দর উন্নয়ন বিষয়ে কোনো দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ হিসেবে করা হচ্ছে? তা স্পষ্ট করতে হবে বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।
বুধবার (২৬ নভেম্বর) রাতে টিআইবি থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এতথ্য নিশ্চিত জানানো হয়েছে।
সম্প্রতি ডেনমার্কের মালিকানাধীন এপিএম টার্মিনালস ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেডলগ এসএর সঙ্গে যথাক্রমে লালদিয়া ও পানগাঁও চুক্তি সম্পাদনের উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বন্দরসহ বিভিন্ন খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে যে কোনো উদ্যোগ সাধুবাদ যোগ্য। তবে এক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাসহ এ জাতীয় চুক্তিতে জাতীয় স্বার্থসম্পর্কিত বিষয়াবলী কীভাবে সংরক্ষিত হয়েছে, তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে, যে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, তারা কিন্তু এখানে ‘‘জনসেবা বা চ্যারিটি’’ করতে আসেনি। তাদের বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মুনাফা অর্জন। তাই স্বাভাবিকভাবেই সরকারকেও আমাদের দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি ও জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় নিতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা অর্জনের পুঙ্খনাপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ জরুরি।
তাছাড়া, যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লালদিয়া টার্মিনাল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কাজে তার আন্তর্জাতিক পরিচিতি যদি মূল বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে ব্যবসা পরিচালনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার চর্চা এবং দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নে সংস্থাটির আন্তর্জাতিক ট্রাকরেকর্ড বিশ্লেষণও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কী-না! এক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকি নিরসনে এবং দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক শর্তাবলী চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কী-না, তা-ও প্রকাশ করা উচিত।
একইসঙ্গে ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট মানদণ্ডে অন্যান্য সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে এপিএম টার্মিনালসকে বেছে নেওয়া হয়েছে, তার ব্যাখ্যা জনগণকে অবহিত করা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের দায়বদ্ধতার অংশ।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বন্দরকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনদের ওপর এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে কী-না? সর্বোপরি জনগণের স্বার্থ কতটা মূল্যায়িত হয়েছে বা এ খাতে নিজম্ব দক্ষতা ও সামর্থ্য বিকাশে এই চুক্তি কতটা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কী-না? অধিকন্তু দীর্ঘমেয়াদি এই চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি হিসেবে সুনির্দিষ্ট কোনো অর্থনৈতিক কৌশলগত পথনকঁশা আছে কী? যেহেতু সরকার ইতোমধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তাই স্বচ্ছতার প্রশ্নে অনতিবিলম্বে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জনসাধারণকে জানাতে হবে।’
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, ‘এপিএম চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরার্মশক প্রতিষ্ঠান (্ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার) ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) প্রতিবেদনে প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর চুক্তি শেষ করতে ৬২ দিন সময়সীমা প্রাক্কলন করা হলেও, প্রস্তাব দাখিল থেকে শুরু করে প্রধান উপদেষ্টার চূড়ান্ত অনুমোদনসহ চুক্তি স্বাক্ষর পর্যন্ত ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, (কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন, নেগোসিয়েশন, বন্দর বোর্ড সভা এবং নৌপরিবহন ও আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, লেটার অব অ্যাওয়ার্ড) যার প্রতিটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে পুঙ্খনাপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ অপরিহার্য। অথচ এর প্রতিটি স্তর অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে অতিক্রম করে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার যৌক্তিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে। অতএব এ ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রকাশ করা জরুরি। তা ছাড়া, পানগাঁও টার্মিনাল চুক্তি প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করে হয়ে থাকলে, লালদিয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম প্রক্রিয়া অনুসরণের পেছনে যুক্তি-ই বা কী ছিলো? তা সরকারকে স্পষ্ট করার আহ্বান জানাই।’
চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে দেশীয় অংশীজনের মতামতকে কতটা মূল্যায়ন করা হয়েছে? প্রশ্ন রেখে ড. জামান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ জাতীয় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকির যেসব উদাহরণ রয়েছে, পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রতিকার ও দায় পরিশোধের প্রশ্নে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু, এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কী-না? একইসঙ্গে বিনিয়োগের ফলে বিদেশি অপারেটর মুনাফা হিসেবে যা আয় করবে, তার বিনিময়ে রাষ্ট্র কী অর্জন করবে, এর কোনো কস্ট-বেনিফিট বিশ্লেষণ হয়ে থাকলে এবং চুক্তিতে দেশের জনগণের আর্থিক লাভ-ক্ষতির বিষয়টি কীভাবে, কতখানি উল্লেখ আছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি নিরসনে সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করতে হবে।’