Thursday 27 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভূমিকম্প আতঙ্ক
‘রেড জোন’ রংপুর অঞ্চলে ১৬ বছরে ১৮৫ বার কম্পন!

রাব্বী হাসান সবুজ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৭ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:০১

ভূমিকম্পের রেড জোন রংপুর অঞ্চল। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

রংপুর: ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে রংপুর অঞ্চল। গত ১৬ বছরে অন্তত ১৮৫ বার কম্পন অনুভূত হয়েছে এই অঞ্চলটিতে। মাটির নিচের সেডিমেন্টের অভাব, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের আশঙ্কাজনক হ্রাস এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ এই ঝুঁকিকে আরও প্রকট করেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, যদি সাত মাত্রার কম্পন দেড় মিনিট স্থায়ী হয়, তাহলে পুরো অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে।

সর্বশেষ ২১ নভেম্বর ২০২৫-এ নরসিংদিতে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প রংপুর অঞ্চলেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সেইসঙ্গে এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সিসমিক অ্যাকটিভিটির স্পষ্ট সংকেত। ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত ১০৬টি কম্পন রেকর্ড হয়েছে, যার মধ্যে একটি পাঁচ মাত্রার উপরে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ২৯ বছর আগেই রংপুর অঞ্চলকে ভূমিকম্পের রেড জোন ঘোষণা করা হলেও সরকারি উদ্যোগের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো এখনো অপসারণ হয়নি। উপরন্তু বিল্ডিং কোড না মেনে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। গবেষকরা বলছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের দুর্যোগ অনিবার্য, যা লাখ লাখ মানুষের জীবনহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

রংপুরের ভূমিকম্পের ভয়াবহ চিত্র

রংপুর অঞ্চলের ভূমিকম্পের ইতিহাস গভীর এবং আতঙ্কজনক। ১৮শ’ শতকের শেষভাগে চিলমারীতে সাড়ে আট মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যার ফলে যমুনা নদীর উৎপত্তি ঘটে। গত ২১ বছরে এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল না থাকলেও, আশেপাশের ফল্ট লাইনগুলোর কারণে কম্পন অনুভূত হয়েছে।

আবহাওয়া অফিস বলছে, ২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ১৮৫ বার কম্পন রেকর্ড হয়েছে। ২০০৭ সালে ২৫ বার, ২০০৮ সালে ৪০ বার, ২০০৯ সালের আগস্টে ৫ বার এবং সেপ্টেম্বরে ৩ বার। ২০১০ সালে সেপ্টেম্বরে ২ বার। ২০২০ সালে ৭৪ বার কম্পন হয়। যার মধ্যে ৩-৪ মাত্রার ৩৫ বার, ৪-৫ মাত্রার ৩৩ বার এবং ৫-৬ মাত্রার ৬ বার।

রংপুর অঞ্চলে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বড় ভূমিকম্পগুলোর চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

রংপুর অঞ্চলে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বড় ভূমিকম্পগুলোর চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আরও উদ্বেগজনক। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল দুপুরে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার কম্পন ২৫-৩০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়, যা রংপুরবাসীকে ভয়ে রাস্তায় নামায়। একই বছরের ৫ জানুয়ারি ভোরে ৬ দশমিক ৭ মাত্রার দুই দফা কম্পন অনুভূত হয়। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ৬ দশমিক ৮ মাত্রার কম্পন সোয়া মিনিট স্থায়ী হয়। ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল রাতে ৫ দশমিক ১ মাত্রার মৃদু কম্পন মাপা হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভুটান।

২০২৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রংপুরের বদরগঞ্জে ২ দশমিক ৯ এবং কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীতে ২ দশমিক ৪ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়। সর্বশেষ ২১ নভেম্বর দেশব্যাপী ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। যার উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর ঘোরাশালে। যাতে অন্তত ১০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলে ১০৬টি কম্পন রেকর্ড হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরগুলোর চেয়ে বেশি। এছাড়া, ২০২৪-২৫-এ উত্তরাঞ্চলে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার কম্পন এবং অন্যান্য মাইনর কম্পন রংপুরকে সতর্ক করেছে।

ঝুঁকির কারণ ফল্ট লাইন, পানির হ্রাস ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় রংপুর অঞ্চলকে ভূমিকম্পের রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৯৬ সালে। কিন্তু কার্যকর উদ্যোগের অভাব স্পষ্ট। ২০১৪ সালের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গবেষণায় ‘বগুড়া, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর ও টাঙ্গাইলের জন্য সিটি করপোরেশন/পৌরসভা এলাকা’র এটলাস বাংলাদেশ সিসমিক রিস্ক অ্যাসেসমেন্টে রংপুর নিয়ে ভয়াবহ প্রতিবেদন উঠে আসে। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে রংপুরে ব্যাপকহারে ভবনধ্বসের পাশাপাশি রেললাইন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

গবেষণায়, বাংলাদেশকে চারটি সিসমিক জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। জোন-১ (সিলেট, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ), জোন-২ (রংপুর, ময়মনসিংহ); যা মিডিয়াম হ্যাজার্ড ক্যাটাগরিতে পড়ে, কিন্তু মধুপুর ফল্ট এবং শিলং ফল্টের মাঝামাঝি অবস্থানের কারণে ঝুঁকি বেশি। মধুপুর ফল্ট টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-গাজীপুরের পশ্চিমে চলে, যা ৬ দশমিক ৫-৭ মাত্রার কম্পন ঘটাতে পারে এবং রংপুরে প্রভাব ফেলে।

আরেকটি বড় কারণ, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের আশঙ্কাজনক হ্রাস, যা মাটির সেডিমেন্ট কমিয়ে কম্পনের প্রভাব বাড়ায়। গবেষকরা সতর্ক করছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বড় কম্পনের সম্ভাবনা রয়েছে। রংপুর ডিভিশনে ২০২৩ সালে নয়টি কম্পন হয়েছে, সবচেয়ে শক্তিশালী ৫ দশমিক ৩ মাত্রার। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ এবং ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে গুরুত্ব দিতে হবে।

রংপুর জেলা শহর। ছবি: সংগৃহীত

রংপুর জেলা শহর। ছবি: সংগৃহীত

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান রিপন সারাবাংলাকে বলেন, ‘হিমালয়ের কাছে হওয়ায় ঝুঁকি বেশি। যদি উৎপত্তিস্থল রংপুর হয়, তাহলে সাত মাত্রার বেশি হবে। পানির স্তর নামায় ঝুঁকি বেড়েছে।’

অপরিকল্পিত নগরায়ণও একটি প্রধান সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিল্ডিং কোড না মেনে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে, যা কম্পনে ধসে পড়তে পারে। রংপুর নগর ভবনে ৪৭টি পরিত্যক্ত সরকারি স্থাপনা (জেলা প্রশাসক ভবন, পুলিশ সুপার ভবন, সার্কিট হাউজ) রয়েছে, যেগুলো সাময়িক সংস্কার করে চালানো হচ্ছে।’

কিন্তু রংপুর সিটি করপোরেশনের গতিমুখ তার উল্টো দিকে। রংপুরে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ করা হয়নি ১৩ বছরেও। শুরুর দিকে একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হলেও সেটিও অনুমোদিত নয়। ফলে রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকা গড়ে উঠেছে যার যার খেয়ালখুশি মতো। বিগত তিন দশকের মধ্যে রংপুর শহরে অগনিত পুকুর ও দিঘি ভরাট হয়ে গেছে।

রংপুর সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান নেই, জনবল নেই, বলা হচ্ছে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হবে। তাও হচ্ছে না। যার কারণে এই শহরে আমরা সন্তুষ্ট নই। এই শহর বাঁচানোর জন্য নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অতীব জরুরি। নইলে এই শহর অচিরেই পুরান ঢাকার মতো অবস্থা ধারণ করবে।’

রংপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক বাদশা মাসুদ আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘হিমালয় কাছে হওয়ায় ঝুঁকি বেশি। ৬ মাত্রার বেশি কম্পনে বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। উপকরণের সংকট আছে, কিন্তু সচেতনতা বাড়াচ্ছি।’

সরকারি উদ্যোগের অভাব: প্রস্তুতির শূন্যতা এবং সম্ভাব্য দুর্যোগ

২৯ বছর রেড জোন ঘোষিত হলেও কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ২০২০ সালে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে তিন দিনের বৈঠক হয়, যেখানে সিটি মেয়র, জেলা প্রশাসন, পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা সুপারিশ পাঠান, কিন্তু অগ্রগতি অজানা। সরকারি স্থাপনাগুলোর তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু অপসারণ হয়নি। অপরিকল্পিত নগরায়ণে বহুতল ভবন এবং পরিত্যক্ত স্থাপনায় কার্যক্রম চলছে, যা দুর্যোগকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ, বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়ানো, উদ্ধারকারী দলের প্রশিক্ষণ এবং উপকরণ সংগ্রহ জরুরি। রংপুরকে প্রায়োরিটি দিয়ে ম্যাপিং এবং প্রস্তুতি পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে। অন্যথায়, একটি বড় কম্পন উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি ও জীবন ধ্বংস করতে পারে।

নগরীর বাসিন্দা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগের শিক্ষক মাহামুদুল হকের দাবি, এখন আর প্রতিশ্রুতি নয়, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ, বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে চাই কঠোর পদক্ষেপ।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর