হাওরে বন্যার জন্য দায়ী অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও সমন্বয়হীনতা
১৪ জুলাই ২০১৮ ০৮:৩৬
।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: হাওরে আগাম বন্যা কিংবা বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার জন্য অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছে খোদ হাওর উন্নয়ন বোর্ড। তারা বলছে, ইতোপূর্বে যেভাবে এ এলাকায় বাঁধ নির্মাণ হয়েছে তাতে হাওড়ের জীববৈচিত্র ও হাওরের স্বকীয়তা অনেকাংশে বিনষ্ট হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সামনের দিনগুলোয় হাওরাঞ্চলের পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে হাওর উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মো. মজিবুর রহমান সারাবাংলা’কে বলেন, হাওরে বন্যার কারণ মূলত উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল। আর হাওরের বাঁধ এবং রাস্তাগুলোও পূর্ব-পশ্চিমমুখী। ফলে পানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাস্তা কিংবা বাঁধের উপর বক্স কালভার্ট এবং স্লুইসগেটগুলোর নির্মাণ ত্রুটিপূর্ণ হলেও সেই একই নিয়মেই এগুলো নির্মিত হচ্ছে । ফলে পানি দক্ষিণের দিকে নেমে যেতে পারছেনা।
হাওরাঞ্চলের বন্যার জন্য স্লুইস গেটকে অনেকাংশে দায়ী উল্লেখ করে জলবায়ু ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, স্লুইস গেটগুলোর নকশা ১৯৭০ সালের। সেগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে আর কাজ করছেনা। অথচ বাঁধগুলোতে এ গেটগুলো রয়েছে। কোথাও কোথাও বক্স কালভার্টও বন্যার পানি আটকে রাখছে। বন্যার পানি দ্রুত অপসারণ করতে হলে এ এলাকার স্লুইস গেট, কালভার্ট ও অপ্রয়োজনীয় বাঁধগুলোর অপসারণ করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হাওর এলাকার জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন আসছে এমন উল্লেখ করে ড.আইনুন নিশাত আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এখন থেকেই হাওরাঞ্চলের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ প্রয়োজন। তা না হলে এখানকার উন্নয়ন প্রকল্প ১০ বছর পর আবারও গলার কাঁটা হবে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত জেলা মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোট হাওর রয়েছে ৩৭৩ টি। প্রায় ২ কোটি মানুষের আবাসস্থল এ হাওরে মোট ভূমির পরিমাণ ১৯ লাখ ৯ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে চাষযোগ্য জমি রয়েছে প্রায় ৯ লাখ হেক্টর। বিশাল এ এলাকায় চাষ হওয়া বোরো ধান দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অকাল বন্যার কারণে শস্য ভান্ডারখ্যাত এ হাওরে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্টরা বলছেন অপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত বাঁধ আর রাস্তাগুলোতে ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না আনলে সামনের দিনগুলোয় হাওরবাসীর স্থায়ী দু:খের কারণ হতে পারে এ হাওর।
সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পরিচালিত মাঠ পর্যায়ের এক জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের আগাম বন্যায় সিলেট বাদে অন্য ৬ জেলর ৬২ টি উপজেলার মোট ৫১৮ টি ইউনিয়নের ৮ লাখ ৫০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় ২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমির বোরো ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাওর এলাকার মানুষের জীবীকার একমাত্র উৎস হওয়ার কারণে বোরো ফসল হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে হাওর-বাসী। এছাড়া বন্যায় ৬৬২ কিলোমিটার রাস্তা এবং ১৩৩ কিলোমিটার বাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আকস্মিক বন্যার কারণ চিহ্নিতকরণ ও দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ঝুঁকি হ্রাসে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর/দপ্তর ও জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে ২৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘ সময় কাজ করা পর ওই কমিটি হাওরাঞ্চলে বন্যার ভৌগলিক ও কাঠামোগত কারণ খুঁজে বের করে। সে সময় ভৌগলিক কারণ হিসেবে অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, পলি পড়ে হাওড়ের তলদেশ ভরাট হওয়া, খালগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলে বন্যার সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়।
এছাড়া কাঠামোগত কারণ হিসেবে হাওরে পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ঘাটতি, সময়মত ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ না হওয়া, প্রয়োজনের তুলনায় বাঁধগুলোর উচ্চতা কম হওয়া, উজানে অপরিকল্পিত নগরায়ন, স্থাপনা শিল্প কারখানা স্থাপন এবং নদীপথে বিভিন্ন স্থাপনার কারণে পানি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হয় বলে উল্লেখ করা হয়।
হাওর বাঁচাতে হলে বিদ্যমান বাঁধগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, প্রয়োজনে পানি প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বাঁধগুলো অপসারণ করে পুনরায় পরিকল্পনা মাফিক বাঁধ নির্মাণ এবং যেসব বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলোর ডিজাইন পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপর অনুমোদন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া বন্যার কারণ সম্পর্কে জাতীয় ওই কমিটি অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণ খুঁজে পেয়েছে। প্রতিবেদনে তারা দেখিয়েছে হাওরে বন্যার জন্য স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব অনেকাংশে দায়ী। কমিটি বলছে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা রাস্তা সংলগ্ন খালে বাঁধ দিয়ে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ, মাছ চাষের জন্য অধিক সময় পানি ধরে রাখায় ধান চাষ বিলম্বিত হওয়া, ব্যাপকহারে বন ধ্বংস ও বৃক্ষ নিধনের ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ফসল রক্ষা বাঁধে নৌ চলাচল, পানি নিষ্কাশনসহ বিভিন্ন কারণে জনগণ বাঁধ কেটে দিলেও সময়মত সেগুলো মেরামত না করায় বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তারা বেশ কিছু সুপারিশও তুলে জমা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে।
সারাবাংলা/এমএস /জেডএফ/এএস