লক্ষ্য সবার কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া : প্রধানমন্ত্রী
১৪ জুলাই ২০১৮ ১৩:৫৪
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
পাবনা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রথমেই প্রয়োজন নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ। সাধারণ মানুষও সব কিছুর আগে বিদ্যুৎ চাই। আমরা দেশের সকল মানুষের কাছে এবং সব সেক্টরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি।’
শনিবার (১৪ জুলাই) পাবনার রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিটের ফার্স্ট কংক্রিট পোরিং ডেট (কংক্রিটের ঢালায়) কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রূপপুর প্রকল্পের কংক্রিট ঢালাই কাজের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনো ভয়ভীতি নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন অনেক উন্নত প্রযুক্তি এসে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তার পরিকল্পিত সব ব্যবস্থা মেনেই এই প্রকল্প হাতে নিয়েছি। রাশিয়া ও ভারতে আমাদের ছেলে-মেয়েদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা অনেক মেধাবী।’
এ ছাড়া যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাতে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো ক্ষতি না করতে পারে তার সবকটি ব্যবস্থায় আমরা নিচ্ছি বলেও জানান তিনি।
৩৩তম পারমাণবিক শক্তির দেশ হিসেব বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে একথা কেউ চিন্তাই করতে পারতো না। এর জন্য অনেকগুলো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে হয়। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেগুলো শুরু করে দিয়েছিল, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সব বাহিনীই সমন্বিতভাবে কাজ করবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা পরিকল্পিতভাবেই এই বিদ্যু প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এখানে রুশ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। যেকোনও দুর্যোগ মোকাবেলায় রাশিয়া আমাদের পাশে থাকবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্রাদিমির পুতিনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাদের পাশের থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
২০১৭ সালের ৩০শে নভেম্বর প্রথম ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই অনুষ্ঠানেও আমি উপস্থিত ছিলাম। বিগত সাত মাসে প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। আজকে কংক্রিট ঢালাইয়ের মাধ্যমে শুরু হলো দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে সমর্থ হব।
ওƒপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এই ভূখ-ে একটি পারমাণবিক বিদ্যুকন্দ্র নির্মাণের স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। ভূমি অধিগ্রহণসহ বেশকিছু পূর্ত কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। পশ্চিম পাকিস্তানে সেটি সরিয়ে নেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী কাজের বেশ খানিকটা অগ্রগতি হয়।
কিন্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর অনেক কর্মসূচির মত এই প্রকল্পের কাজও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা জ্বালানি নীতিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করি।
এবিষয়ে তিনি আরও বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা ক্ষমতায় এসেই আমাদের নেওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি বাতিল করে দেয়। এরমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটিও ছিল। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প ছিল জাতির পিতার স্বপ্নের প্রকল্প। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আমরা আবার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি। বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়া এটি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ অপরিহার্য। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন পর্যাপ্ত এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ। সাধারণ মানুষও সবকিছুর আগে বিদ্যুৎ চান। আমরা দেশের সকল মানুষের কাছে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক সেক্টরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি।
২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন পেয়েছিলাম মাত্র ৩২০০ মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় তখন ভয়াবহ লোড-শেডিং হতো।
দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই আমরা বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমরা স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘ-মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করি। তার ফলেই আজ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১৮ হাজার ৩৫৩ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। কোন লোড-শেডিং নেই। ৯০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছেন।
যেখানে এখনও বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন পৌঁছেনি সেখানে সোলার হোম সিস্টেম চালু করা হয়েছে। সারাদেশে বর্তমানে ৪৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম আছে।
টেকসই বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য আমরা জ্বালানি নীতিতে জীবাষ্ম জ্বালানির পাশাপাশি বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের উপর জোর দিয়েছি। অর্থাৎ তেল, গ্যাস বা কয়লার পাশাপাশি পারমাণবিক, সৌর এবং বায়ু-চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর গুরুত্বারোপ করেছি।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। আশা করি, ২০২৩-২৪ সাল নাগাদ এ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে আমাদের জাতীয় গ্রিডে।
২০২৪ সালের মধ্যে আমাদের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ আসবে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বলেও জানান তিনি।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কোন কোন মহল উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন। বিশেষ করে এর নিরাপত্তা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরাও এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। এটি নির্মাণে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার গাইডলাইন এবং আন্তর্জাতিক মান অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হচ্ছে। রাশিয়ার সর্বশেষ জেনারেশন থ্রি প্লাস প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর দিয়ে তৈরি হচ্ছে এ কেন্দ্র। পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণের সর্বাধুনিক ব্যবস্থা আছে এ রিঅ্যাক্টরে। জনগণের জন্যে কোন ঝুঁকি যাতে সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে গ্রহণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা রয়েছে।
যে কোন দুর্যোগে আমাদের এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকটি বিবেচনায় নিয়েই এই প্ল্যান্টের ডিজাইন করা হয়েছে। আমি আগেই বলেছি রাশান ফেডারেশনের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাকে নিরাপত্তার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এবং সকল প্রকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে।
আজ আমরা সোনার বাংলা বির্নিমাণের পথে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছি। গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ সবকটি শর্ত ভালোভাবে পূরণ করে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা দেয়।
গত মে মাসে মহাকাশে আমরা আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপন করেছি। রাজধানীতে মেট্রোরেলের কাজ এগিয়ে চলছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের প্রায় ৫৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে। আমরা এই দুই শুভক্ষণকে সামনে রেখে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিকে আরও বেগবান করতে চাই।
আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞানভিত্তিক মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা।
এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির কার্যক্রম আমরা গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের ভারত ও রাশান ফেডারেশনে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। শুধু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, স্যাটেলাইট পরিচালনার জন্যও আমরা নিজস্ব জনবল তৈরি করছি।
আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়ের অভাব নেই। যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে পারলেই আমাদের ছেলেমেয়েরাই এই উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।
আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানে রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী ইউরি ইভানোভিচ রোরিসভ, আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পরিচালক দোহি হ্যান, রোসাটমের উপমহাপরিচালক আলেকজান্দার রাস্কিনও বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে কনক্রিট ঢালাইয়ের কাজ উদ্বোধনের পর সেখানে রুশ উপপ্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা।
সারাবাংলা/এমআই
আরও পড়ুন:
৩১ উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনে পাবনা যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী