এই মাটির প্রতিটি কণায় লুকিয়ে আছে রক্তের গল্প… স্বপ্নের জন্য, ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য— যে লক্ষ প্রাণ নিঃশব্দে হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়, তাদেরই অমর স্মৃতির সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক গর্বিত প্রতীক— জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা এবং বেসামরিক বাঙালি ও অবাঙালিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই জাতীয় স্মৃতিসৌধটি অবস্থিত ঢাকার অদূরে সাভারে। এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়— এটি একটি জাতির আত্মত্যাগ, বেদনা ও বিজয়ের ইতিহাস।
জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশা প্রণয়ন করেন বিশিষ্ট স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। স্মৃতিসৌধে রয়েছে সাতটি স্তম্ভ, যা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের প্রতীক।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, বিজয় দিবসে— বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে নবীনগরে এই স্মৃতিসৌধের শিলান্যাস করেন।
পরবর্তীতে, ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই বছর আহ্বান করা নকশা প্রতিযোগিতায় জমা পড়ে ৫৭টি নকশা, যার মধ্য থেকে নির্বাচিত হয় সৈয়দ মাইনুল হোসেন প্রণীত নকশাটি।
১৯৭৯ সালে শুরু হয় মূল নির্মাণকাজ ১৯৮২ সালে, বিজয় দিবসের অল্প আগে স্মৃতিসৌধের নির্মাণ সম্পন্ন হয়। ২০০২ সালে গৃহীত প্রকল্প অনুযায়ী এখানে অগ্নিশিখা, সুবিস্তৃত ম্যুরাল এবং একটি গ্রন্থাগার স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সফরকারী বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানরা রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অনেক বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক নিজ হাতে এখানে স্মারক বৃক্ষরোপণ করে থাকেন।
স্মৃতিসৌধ ও এর প্রাঙ্গণের মোট আয়তন ৩৪ হেক্টর বা ৮৪ একর। একে ঘিরে রয়েছে ২৪ একর জুড়ে বৃক্ষরাজিশোভিত সবুজ বলয়। স্মৃতিস্তম্ভের উচ্চতা ৪৫ মিটার বা ১৫০ ফুট। মিনার ঘিরে রয়েছে কৃত্রিম হ্রদ ও সুপরিকল্পিত বাগান।
সাত স্তম্ভ, সাত আন্দোলন- সাত জোড়া ত্রিভুজাকৃতি দেয়াল ছোট থেকে বড় আকারে সাজানো— বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে …
১৯৫২ – ভাষা আন্দোলন,
১৯৫৪ – যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন,
১৯৫৬ – সংবিধান আন্দোলন,
১৯৬২ – শিক্ষা আন্দোলন,
১৯৬৬ – ছয় দফা আন্দোলন,
১৯৬৯ – গণঅভ্যুত্থান,
এবং ১৯৭১ – মহান মুক্তিযুদ্ধ।
এই সাত ধাপ পেরিয়েই বাংলাদেশ অর্জন করেছে চূড়ান্ত বিজয়।
স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে রয়েছে দশটি গণকবর, যেখানে শায়িত আছেন মাতৃভূমির জন্য আত্মোৎসর্গকারী অজ্ঞাতনামা শহীদরা।
এছাড়াও রয়েছে— উন্মুক্ত মঞ্চ, অভ্যর্থনা কক্ষ, মসজিদ, হেলিপ্যাড, ক্যাফেটেরিয়া।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ শুধু অতীতকে স্মরণ করায় না, এটি আমাদের দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দেয়। কারণ স্বাধীনতা কোনো উপহার নয়— এটি এসেছে রক্ত, ত্যাগ আর অশ্রুর বিনিময়ে।
আর তাই— প্রতি বছর ২৬শে মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবসে, এবং ১৬ই ডিসেম্বর, বিজয় দিবসে, লাল-সবুজের ভালোবাসা বুকে নিয়ে লাখো জনতার ঢল নামে এই স্মৃতিসৌধে। ফুলের তোড়ায়, নীরব শ্রদ্ধায়, মানুষ স্মরণ করে এই দেশের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের— যাদের আত্মত্যাগে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন বাংলাদেশ।
যতদিন উড়বে লাল-সবুজ পতাকা, ততদিন জাতীয় স্মৃতিসৌধ থাকবে বাংলার মানুষের গর্ব, কৃতজ্ঞতা ও আত্মপরিচয়ের চিরন্তন ঠিকানা।