জবি: বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে ‘ঘৃণার প্রতীক’ হিসেবে পাকিস্তানের পতাকা আঁকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ক্যাম্পাসে তীব্র উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একদল শিক্ষার্থী পতাকা আঁকতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আরেকদল শিক্ষার্থীর বাধার মুখে পড়েন। পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠলে লাঞ্ছনার শিকার হন এক সাংবাদিক। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের অংশগ্রহণে সড়কে পাকিস্তানের পতাকা এঁকে তাতে জুতার ছাপ দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) রাত ১২টার পর বিজয় দিবস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান ফটকের সামনে সড়কে একদল শিক্ষার্থী পাকিস্তানের পতাকা আঁকতে উদ্যোগ নেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, একাত্তরের গণহত্যা, নির্যাতন ও পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার স্মরণে এবং শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই প্রতীকী কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু পতাকা আঁকার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে কর্মসূচিতে বাধা দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া এ ধরনের কাজ না করার পরামর্শ দেন। এতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রক্টরের তর্ক শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তোলেন, এর আগে ক্যাম্পাসে ইসরায়েলের পতাকা আঁকার সময় অনুমতি না লাগলে এবার কেন প্রশাসনিক অনুমতির কথা বলা হচ্ছে।
বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে প্রক্টর ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আস-সুন্নাহ আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা একটি বাসে করে ক্যাম্পাস ত্যাগ করছিলেন। পতাকা আঁকায় ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা বাসটিকে প্রধান ফটক ব্যবহার না করে বিকল্প দ্বিতীয় ফটক দিয়ে যেতে অনুরোধ জানান।
এই অনুরোধের পর বাস থেকে নেমে আসা এক আবাসিক শিক্ষার্থী মন্তব্য করেন, পাকিস্তানের পতাকা আঁকা ঠিক হচ্ছে না ভাই, তাদের সঙ্গে আমাদের এখন মিউচুয়াল হচ্ছে। এই বক্তব্যে আঁকিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ওই শিক্ষার্থী পুনরায় বাসে উঠে যান। এরপর বাসে থাকা শিক্ষার্থীদের একাংশ দলবদ্ধভাবে নেমে আসে এবং পতাকা আঁকায় যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ায়। একপর্যায়ে তারা রঙের কৌটা ঢেলে সড়কে আঁকা পতাকা মুছে দেয়। এতে ঘটনাস্থলে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়।
এই ঘটনার সময় সরাসরি সম্প্রচার করছিলেন দৈনিক কালের কণ্ঠের মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার মিনহাজুল ইসলাম। অভিযোগ উঠেছে, লাইভ চলাকালেই তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। পরে তিনি প্রক্টরের কাছে গিয়ে হামলাকারীদের তাৎক্ষণিক বহিষ্কারের দাবি জানান। এ বিষয়ে প্রক্টর বলেন, ‘অনুমতির অজুহাতে যদি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তবে বিজয় দিবসে যারা পাকিস্তানপ্রীতির প্রকাশ ঘটিয়েছে এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
এ বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক সাংবাদিককে লিখিত অভিযোগ ও ভিডিও প্রমাণ জমা দেওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। পরিস্থিতির উত্তাপ বাড়তে থাকলে উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে চাইলে একদল শিক্ষার্থী তার গাড়ির সামনে বসে পড়ে। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর তিনি প্রশাসনিক ভবনে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
এদিকে আস-সুন্নাহ হলের বাস ক্যাম্পাস ত্যাগ করার পর আবারও প্রধান ফটকের সামনে পাকিস্তানের ‘ঘৃণার প্রতীক’ পতাকা আঁকতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর, রাত দেড়টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ঝটিকা মিছিল বের করে। মিছিলে ‘রাজাকারের বাচ্চারা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘পিন্ডির দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’সহ নানা স্লোগান দেওয়া হয়।
মিছিল শেষে তারা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন এবং সড়কে পাকিস্তানের আরেকটি পতাকা এঁকে তাতে জুতার ছাপ দেন। পতাকা আঁকায় বাধার প্রতিবাদ এবং রাজাকারবিরোধী অবস্থান জানানোর লক্ষ্যে সকাল ১০টায় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও জুতা নিক্ষেপ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সদস্য সচিব শামসুল আরেফিন বলেন, ‘একাত্তরের ৩০ লাখ শহিদ ও দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই প্রতীকী কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, পাকিস্তানের দালালরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে এবং সাংবাদিকদেরও লাঞ্ছিত করেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।’