Tuesday 16 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নির্বাসনের দেড় যুগ
ফিরছেন তিনি, প্রস্তুত হচ্ছে বাসা-অফিস-গাড়ি

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ২৩:৫৮ | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০০:৩৪

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগের নির্বাসিত জীবন। এর মধ্যে ঘটে গেছে অনেক কিছু। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন। পাশের দেশ ভারতে পালিয়ে গেলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে সুগম হলো তার ফেরার পথ। গতবছর থেকেই শোনা যাচ্ছিল দ্রুতই দেশে ফিরবেন তিনি। কিন্তু কোনো দিন-তারিখ উল্লেখ ছিল না। তবে এবার দিন-তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে ২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

এই প্রত্যাবর্তন কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার দেশে ফেরা নয়, এটি রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনাবিন্দু হিসেবে দেখছে রাজনীতি বিশ্লেষকরা। এরই মধ্যে দলটির প্রস্তুতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, বাসভবন ও অফিস সাজানো—সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে অবশেষে ফিরছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

গুলশান এভিনিউ ১৯৬

গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসাটি শুধু একটি বাসভবন নয়, এটি জিয়া পরিবারের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তৎকালীন সরকার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে এই বাড়িটি বেগম খালেদা জিয়ার নামে বরাদ্দ দেয়। দীর্ঘ সময় তার দখলে না থাকলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নামজারির কাগজ বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। কয়েক মাস আগে এই বাড়ির দলিলপত্র বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে হস্তান্তর করেন গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তপক্ষের রাজউকে চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম রিজু। লন্ডন থেকে ফিরে সেই বাড়িতে উঠবেন তারেক রহমান- এমনটিই জানা গেছে।

বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে এসে উঠবেন গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসাটিতে। ছবি: সারাবাংলা


বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে এসে উঠবেন গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসাটিতে। ছবি: সারাবাংলা

সরেজমিনে দেখা গেছে, সাদা রংয়ে নতুন করে রাঙানো বাড়িটির চারপাশে বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা, স্টিল ব্যারিকেড ও পুলিশ বক্স। বাড়ির ভেতরে নতুন দরজা-জানালা লাগানো হলেও এখনো আসবাব আনা হয়নি। বাড়িটিতে তিন বেড রুম, ড্রয়িং, ডাইনিং ও লিভিং রুম রয়েছে। ফাঁকা জায়গায় কিছু গাছও আছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ)। সবকিছু মিলিয়ে, এটি কেবল একটি বাসা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক প্রতীকের প্রস্তুতি।

‘ফিরোজা’র পাশেই নতুন আবাস

১৯৬ নম্বর বাড়ির ঠিক পাশেই ৭৯ নম্বর সড়কে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’। মা ও ছেলের বাসভবন পাশাপাশি হওয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও একীভূত করা হয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া, অতিরিক্ত পুলিশ বক্স এবং নিয়ন্ত্রিত চলাচল—সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা প্রস্তুতির। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুমন জানান, কোনো কারণে ১৯৬ নম্বর বাড়িটি পুরোপুরি প্রস্তুত না হলে তারেক রহমান সাময়িকভাবে ‘ফিরোজা’য় অবস্থান করতে পারেন। অর্থাৎ, সব প্রস্তুতিই বিকল্প পরিকল্পনাসহ করা হয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের ভাড়া করা বাসভবন ‘ফিরোজা’র পাশেই গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসাটি। ছবি: সারাবাংলা

বিএনপি চেয়ারপারসনের ভাড়া করা বাসভবন ‘ফিরোজা’র পাশেই গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসাটি। ছবি: সারাবাংলা

রাজনৈতিক অফিস

তারেক রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হবে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ের পাশেই। গুলশানের ৯০ সড়কের ১০সি বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে বিএনপি অফিস হিসেবে। চার তলায় এই ভবনে রয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এখানে দোতলায় রয়েছে ব্রিফিং রুম। অন্যান্য তলায় বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বসার ব্যবস্থা। রয়েছে গবেষণা সেলও।

একইসঙ্গে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও তারেক রহমানের জন্য আলাদা চেম্বার প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয়, তিনি শুধু প্রতীকী নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ থাকবেন না, বরং সরাসরি মাঠ ও সাংগঠনিক রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন।

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শাইরুল কবির খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যারা দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছি, তারা অধীর আগ্রহে সময় গুনছি। আমার অপেক্ষায় আছি, কখন আমাদের বহুদলীয় গণতন্ত্রের মানসপুত্র, আধুনিক স্বনির্ভর রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দ্রষ্টা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঢাকার মাটি পা রাখবেন।’

অভ্যর্থনার প্রস্তুতি

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছবেন। বাংলাদেশ বিমানের একটি সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানে তিনি লন্ডন থেকে যাত্রা করবেন। নির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী বিমানটি প্রথমে সিলেটের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে পরে ঢাকায় আসবে। তার সঙ্গে থাকবেন কন্যা জাইমা জারনাজ রহমান।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের নেতার অপেক্ষায় আছে দেশবাসী। সেদিন দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী সড়কের দুই পাশে সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান নিয়ে প্রিয় নেতাকে অভ্যর্থনা জানাবে। আমরা সেই প্রস্তুতির কাজ করছি।’ দলীয় সূত্র জানায়, যাতে জনদুর্ভোগ না হয় এবং শৃঙ্খলা বজায় থাকে, সে বিষয়েও নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসাটিতে চলছে কর্মযজ্ঞ কাজ। ছবি: সারাবাংলা

গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসাটিতে চলছে কর্মযজ্ঞ কাজ। ছবি: সারাবাংলা

নিরাপত্তা প্রশ্নে সতর্কতা ও বাস্তবতা

তারেক রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার জন্য বিশেষ ডিজাইনের বুলেটপ্রুফ গাড়ি আনা হয়েছে। সিএসএফ সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে ১০ জন থেকে ২৫ জনের বেশি করা হয়েছে। তবে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলাচল ও জনসম্পৃক্ততার সময় রাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে। এ বিষয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবরের বক্তব্য রাজনৈতিক বাস্তবতারই প্রতিফলন, ‘জননেতার নিরাপত্তা শুধু দলীয় ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ রাখা যায় না।’

চলাচলে বুলেটপ্রুফ গাড়ি

তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকায় আনা হয়েছে দুটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি। বিএনপির সূত্র জানায়, জিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এই বিশেষ গাড়িগুলো আমদানি করা হয়। পরে কমলাপুর আইসিডি থেকে গাড়িগুলোর শুল্ক ও কাগজপত্র ছাড় করানো হয়। এ বিষয়ে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। তার নিরাপত্তার জন্য যা যা প্রয়োজন, সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হবে।’

গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসা। ছবি: সারাবাংলা

গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসা। ছবি: সারাবাংলা

নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের নেতা তারেক রহমান ফিরছেন, আমরা আনন্দিত। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তারেক রহমানকে এখন বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হতে যাচ্ছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এই খবর শুনে আরও উদ্বেলিত ও আনন্দিত। দলের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। সবাই ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন।’ বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

যুক্তরাজ্য অধ্যায়ের সমাপ্তি

বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, লন্ডনে তারেক রহমানের রাজনৈতিক অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য শাখার নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে জনসম্মুখে দেওয়া ভাষণটিই ছিল সেখানে তার শেষ বক্তব্য। দলীয় সূত্র জানায়, যুক্তরাজ্যের অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তারেক রহমানের দেশে ফেরাসংক্রান্ত সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট বা ট্রাভেল ডকুমেন্ট সংগ্রহ করলেই তিনি দেশে ফিরবেন।

গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসাটিতে চলছে ঘষা-মাজার কাজ। ছবি: সারাবাংলা

গুলশান এভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসাটিতে চলছে ঘষা-মাজার কাজ। ছবি: সারাবাংলা

রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসছে

বিএনপির নেতারা মনে করছেন, তারেক রহমানের সরাসরি উপস্থিতি দলকে নতুন উদ্দীপনা দেবে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল মাহমুদ টুকুর ভাষায়, ‘তিনি দূরে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এবার সামনে থেকে দেবেন।’ তৃণমূলেও এই প্রত্যাবর্তনকে দেখা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস ফেরার মুহূর্ত হিসেবে।’ দীর্ঘ ১৭–১৮ বছর পর একজন নির্বাসিত নেতার দেশে ফেরা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল ঘটনা নয়। তবে এই ফেরা এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস, নির্বাচনি প্রস্তুতি ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের আলোচনা জোরালো।

রাজনীতির নতুন সমীকরণ

তারেক রহমানের ফেরা মানে শুধু একটি ফ্লাইটের অবতরণ নয়। এটি বিএনপির জন্য সাংগঠনিক পুনর্জাগরণ, সমর্থকদের জন্য আবেগী প্রত্যাশা এবং প্রতিপক্ষের জন্য নতুন সমীকরণ। গুলশানের সাদা দেয়াল, সিসিটিভি ক্যামেরা আর নিরাপত্তা বেষ্টনীর আড়ালে প্রস্তুত হচ্ছে একটি রাজনৈতিক অধ্যায়—যার পরিণতি নির্ভর করবে নেতৃত্ব, কৌশল এবং সময়ের বাস্তবতার ওপর।

বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর