ঢাকা: বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এইডস রোগীর সংখ্যা। সর্বশেষ মাসগুলোতে এই সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে আঁতকে ওঠার মতো অবস্থা। চলতি বছর প্রতিমাসে গড়ে ১৮০ জন করে এইডস রোগী শনাক্তের তথ্য প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি খুবই উদ্বেগজনক। এইডস নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার ও সতর্ক না হলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে চলতি বছরের ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর/২০২৫) হিউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাসে (এইচআইভি ভাইরাস) আক্রান্ত এক হাজার ৮০০ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতি মাসে ১৮০ জন এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী শনাক্ত হয়েছে। দেশের ২৪টি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাকেন্দ্রের মাধ্যমে এসব রোগী শনাক্ত করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, দেশে তিন দশকের বেশি সময়ে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার ৪৮০ জন। যার মধ্যে ১৪ হাজার জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। অবশিষ্ট সাড়ে ৩ হাজার এইচআইভি ভাইরাস বহনকারীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এদিকে, এখন পর্যন্ত এইডস আক্রান্ত হয়ে আড়াই হাজার জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস-এসটিডি কন্ট্রোল শাখার কর্মকর্তারা বলেছেন, এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে যৌন মিলন করলে, একই সুঁই-সিরিঞ্জ ও ইনজেকশন ইকুইপমেন্ট ব্যবহার ও ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে এইচআইভি-এইডস সংক্রমিত হয়।
তথ্য বলছে, এইডস একটি বৈশ্বিক রোগ। মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলাচলের সঙ্গে সঙ্গে এই রোগের বিস্তার বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশে এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত ৮ হাজার ৫০০ জনকে ১৪টি চিকিৎসাকেন্দ্রের মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। দেশে তিন দশকের বেশি সময়ে এইডসে আক্রান্ত ২ হাজার ৫০০ জন মারা গেছে।
তথ্য বলছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালে বিশ্বে থেকে এইডস নির্মূলে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দ্বিতীয় ট্র্যাক স্ট্র্যাটেজি ৯৫-৯৫-৯৫ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ এই স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তদের শতকরা ৯৫ জনকে শনাক্ত করতে হবে। এরপর শনাক্তদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে এবং চিকিৎসাধীন শতকরা ৯৫ জনের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। বর্তমানে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত শতকরা ৯৫ জনের মধ্যে ৮১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এরপর শনাক্তকৃত ৯৫ জনের বিপরীতে ৭৮ জন চিকিৎসার আওতায় আনা হয়েছে এবং চিকিৎসায় ৯৫ জনের মধ্যে ৮৯ জনের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ৯৫-৯৫-৯৫ অর্জন করা যায়নি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, দেশের প্রতিটি জেলায় এইচআইভি পরীক্ষা ও চিকিৎসাকেন্দ্রের স্বল্পতা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে প্রথম এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে এইচআইভি সংক্রমণ শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশের কম। এ সংখ্যাটি এইচআইভি সংক্রমণের জন্য ঝুঁকি নয়। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে এইচআইভি-এইডস সংক্রমণ বেশি হওয়ায় বাংলাদেশকে এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে ধরা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে ধারাবাহিকভাবে এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী শনাক্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিগত যেকোনো সময়ের তুলনায় ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৮০০ জন এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তকে শনাক্ত করা হয়েছে।
এর আগে ২০২৪ সালে ১ হাজার ৪৩৮ জন, ২০২৩ সালে ১ হাজার ২৭৬, ২০২২ সালে ৯৪৭ জনকে শনাক্ত করা হয়। তথ্য বলছে, গেল তিন বছরে (২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪) যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সমকামী পুরুষ ও হিজড়ার সংখ্যা বেশি। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪ শতাংশ (২৫৩ জন), ২০২৩ সালে ২৯ শতাংশ (৩৭০ জন) এবং ২০২২ সালে ৪২ শতাংশ (৬০৪ জন)। আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগের বয়স ২১ থেকে ২৯ বছর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে এইচআইভি-এইডস বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। এখন আগের তুলনায় জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রচার কমে গেছে, এটি বাড়াতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অনেক লোক বিদেশে যায় ও থাকে, তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিমানবন্দরে বিলবোর্ড স্থাপনাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচার চালাত হবে। একটা সময় ছিল নির্দিষ্ট এলাকায় যৌনকর্ম সংগঠিত হতো, এখন সেটি সারা দেশেই ছড়িয়ে গেছে। যুবক ও কিশোর বয়সীরাও এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত হচ্ছে। এইচআইভি-এইডস সংক্রমণ কমাতে হলে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে এবং যারা আক্রান্ত তাদের চিকিৎসা পাওয়া সহজ করতে হবে।’