Saturday 20 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধ্বংসের মুখে রানী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত জমিদার বাড়ি

স্পেশাল করেসপডেন্ট
২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৮:০৫ | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৮:৩৩

রানী ভবানীর জমিদার বাড়ি। ছবি: সারাবাংলা

বগুড়া: বাংলার ইতিহাসের স্মরণীয় এক নাম রানী ভবানী। যিনি ১৭১৬ সালে বগুড়ার আদমদীঘির ছাতিয়ান গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দান, ধ্যান, শিক্ষা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, চিকিৎসা ও ধর্মীয় কাজের স্বীকৃতস্বরূপ তার প্রজারা তাকে ‘মহারানী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এককালের সেই মহারানী রানী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত জমিদার বাড়ি আজ ধ্বংসের মুখে। ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে মহীয়সী এই নারীর জন্মস্থান হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য।

স্থানীয়দের মতে, সরকারি উদ্যোগে জমিদার বাড়িটি সংস্কার করা হলে একদিকে যেমনি এটি ধ্বংস ও দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা পাবে, অন্যদিকে বদলে যাবে ঐতিহাসিক নিদর্শন জমিদার বাড়ি এলাকার পরিবেশ। মহীয়সী রানী ভবানী তার রাজ্য আদমদীঘিতে পানির অভাব মিটাতে ৩৬৫টি পুকুর খনন করেছিলেন। তিনি একেকদিন একেক পুকুরে গোসল করতেন। শুধু তাই নয় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হাট-বাজার, মসজিদ-মন্দির ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ছাতিয়ানগ্রাম। এই গ্রামের জমিদারের নাম ছিলে আত্মারাম চৌধুরী। জমিদারের স্ত্রী ছিলেন শ্রী জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী (তমা দেবী)। তারা ছিলেন নিঃসন্তান। সন্তান লাভের আশায় জমিদার তার বাড়ীর অদূরে নির্জন এক পুকুর পাড়ে ঈশ্বরের সাধনা অর্চনা শুরু করেন। আত্মারাম চৌধুরী যে স্থানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করে ছিলেন সে স্থানটি আজও সিদ্ধেশ্বরী নামে স্মৃতি বহন করে আসছে। সিদ্ধিলাভের পর পরবর্তীতে তার স্ত্রীর গর্ভে ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হলে তার নাম রাখা হয় ভবানী। একজন রাজা জমিদারের যা যা থাকার কথা সবকিছুই ছিল আত্মারাম চৌধুরীর। ভবানী শৈশব থেকে মানুষের সেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। নারীরা সাধারণত বিয়ের আগে কৃতিত্ব অর্জন করতে পারে না। কিন্তু এক্ষেত্রে ভবানী ছিলেন এক ব্যতিক্রম নারী। তিনি ছাতিয়ান গ্রামের গরীব দুঃখী মানুষের কষ্ট নিবারণ করতেন। ধর্ম চর্চার জন্য মসজিদ মন্দির ও পুঁথিগত শিক্ষার জন্য এলাকায় নির্মাণ করেছিলেন স্কুল-মাদ্রাসা।

ভবানীর বয়স যখন ১০ বছর সে সময় একদিন নাটোর রাজবাড়ীর দেওয়ান (মগনেহর) দয়ারাম নবাব আলীবর্দী খানের দরবার থেকে ফেরার পথে ছাতিয়ানগ্রামে এসে রাত হয়ে যায়। সেখানে তাঁবু ফেলা হয় রাত্রিযাপনের জন্য। নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাস ছিল দয়ারামের। ভোরে তিনি শয্যাত্যাগ করে তাঁবু থেক বের হন। বের হয়ে দেখলেন ফুট ফুটে একটি মেয়ে লাল শাড়ী পরে পূজার জন্য ফুল তুলছেন। রাজা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন মেয়েটি আত্মারাম চৌধুরীর একমাত্র কন্যা। যার নাম ভবানী। দেওয়ান নাটোরের রাজকুমার রামকান্তের সঙ্গে ভবানীর বিয়ের প্রস্তাব দিলেন আত্মারামের কাছে। তিনি ভবানীর মতামত জানতে গেলে তিনটি শর্তে বিয়েতে রাজি হন। ভবানীর প্রথম শর্ত ছিল বিয়ের পর তিনি এক বছর পিতার বাড়িতে থাকবেন। এক বছরে প্রতিদিন একটি করে পুকুর স্থাপনের জন্য ছাতিয়ানগ্রামে ৩৬৫টি পুকুর খনন করে দিতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত ছিল ছাতিয়ানগ্রাম থেকে নাটোর পর্যন্ত নতুন রাস্তা নির্মাণ করে পুরো রাস্তায় লাল সালুর কাপড় দিয়ে ছাউনি তৈরি করতে হবে। যার ভেতর দিয়ে ভবানী স্বামীর বাড়ী যাবেন। তৃতীয় শর্ত ছিল এলাকার প্রজাদের ভূমিদান করে তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

সেই সময় এলাকায় পানির অভাব মেটাতে ৩৬৫টি পুকুর খনন করেছিলেন। সেই পুকুরগুলোর সঙ্গে তার স্মৃতি ধরে রাখতে প্রতিদিন একটি করে পুকুরে গোসল করতেন রানী ভবানী। ভবানীর পিতা নাটোরের জমিদার রামাকান্তের চেয়ে ছোট জমিদার ছিলেন। ছাতিয়ানগ্রামে ৩৬৫টি পুকুরের স্মৃতিচিহ্ন আজও বিদ্যমান। আদমদীঘির ছাতিয়ানগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বদিকে যে রাস্তাটির স্মৃতি চিহ্ন রয়েছে সে রাস্তাটির নাম ছিল ভবানীর জাঙ্গাল। সড়কটি ছাতিয়ানগ্রাম থেকে নাটোর পর্যন্ত বিস্মৃত ছিল। এ থেকে প্রমাণ হয় রাজকুমার রামকান্ত সকল শর্ত পূরণ করে রানী ভবানীকে রানী করেছিলেন।

স্থানীয় সমাজসেবক ছাতিয়ান গ্রামের বাসিন্দা ও জেলা বিএনপির সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মাহফুজুল হক টিকন জানান, ‘আমরা শুনেছি রানী ভবানী শিশুকাল থেকেই ছিলেন ধর্ম পরায়ণ ও মানব কল্যাণে নিয়োজিত। তার বিয়ের শর্ত ৩৬৫টি পুকুর এবং রাস্তাটি তার নিজের জন্য করেননি। করেছিলেন জনসাধারণের উপকারের জন্য। সরকারি উদ্যোগে জমিদার বাড়িটি সংস্কার করা হলে একদিকে ধ্বংস ও দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা পাবে। অন্যদিকে বদলে যাবে ঐতিহাসিক নিদর্শন জমিদার বাড়ি এলাকার পরিবেশ।’

ছাতিয়াগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সুদেব কুমার ঘোষ জানান, ‘আমরা ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি রানী ভনানীর রাজবাড়ি ও মন্দির ঝোপ-জঙ্গলে ভরা। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। এখন তার পিতৃগৃহের ধ্বংসাবশেষ আছে মাত্র। ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত জয় দুর্গা মন্দির এবং শিব মন্দির। এগুলো রক্ষার জন্য সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’ তাই তিনি সরকারি উদ্যোগে রানী ভবানীর স্মৃতিচিহৃ রক্ষার্থে এই এলাকায় একটি প্রাচীর নির্মান করার দাবি জানান।

স্থানীয়রা জানান, রানী ভবানীর জন্মস্থান জমিদার বাড়ি এখন শুধুই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন ভেঙে জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। দখল হচ্ছে জমিদার বাড়িসহ আশপাশের জমি। সেই মহিয়সী নারী রানী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত জমিদার বাড়িটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মানুষ এসে ভিড় জমায়। সরকারি উদ্যোগে বাড়িটি সংস্কার করা হলে বদলে যাবে ঐতিহাসিক নিদর্শন জমিদার বাড়ি এলাকার পরিবেশ।

সারাবাংলা/জিজি