ঢাকা: শহিদ শরিফ ওসমান হাদি। সন্ত্রাসীর গুলিতে আহত হয়ে এক সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শাহাদাত বরণ করেন তিনি। আপসহীন বিপ্লবীর জানাজায় লাখ লাখ সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে জনসমুদ্রে রুপ নেয় সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকা। যা ৫ আগস্টের পর একসঙ্গে এতো মানুষের সমাগম আর হয়নি।
শনিবার (২০ ডিসেম্বর) জাতীয় সংসদ ভবন, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ সড়ক ও আশেরপাশের সড়কগুলোতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, জানাজায় অংশ নেওয়া লোকজনে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল জাতীয় সংসদ ভবনের মাঠ। সংসদ ভবনের মাঠ ও বিস্তীর্ণ জাগায় মাত্র একহাত দূরত্ব বজায় রেখে জানাজা নামাজের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায় লোকজন। এরপর লোকজনের ঠাঁই না হওয়ায় তারা অবস্থান নেন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ সড়কজুড়ে। তখনও জানাজায় অংশ নেওয়ার জন্য দূর-দূরান্ত আসছিল সাধারণ মানুষ। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউও লোকজনে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলে তারা অবস্থান নেন আশপাশের সড়কে। এমনকি ফার্মগেটের খামারবাড়ি ও আসাদগেট এবং চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র পর্যন্তও ছিল মানুষ আর মানুষ। এই জানাজায় শিশু, তরুণ, যুবক ও বৃদ্ধসহ আপামর সব শ্রেণির মানুষ অংশ নিয়েছেন। আর এমন দৃশ্য ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর যেন আবার দেখা মিলল।
রাজধানীর উত্তরা জানাজায় অংশ নিতে আসা বুরহান উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘জীবনে অনেক জানাজায় অংশ নিয়েছি কিন্তু এত বড় জানাজা দেখিনি। মানুষের উপস্থিতিতে মনে হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ এসেছে। এটা ওসমান হাদির জন্য সৌভাগ্য। সব শ্রেণির মানুষ আজ আসছে তার জানাজায়।’

বাড্ডা থেকে আসা রিপন শেখ সারাবাংলাকে বলেন, ‘লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা এর আগে কারও হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। তবে ওসমান হাদির জানাজায় মানুষের উপস্থিতি তাক লাগিয়ে দিয়েছে সবাইকে। জুলাই আন্দোলনের সবাই যে ঐক্যবদ্ধ আছে সেটি আজ আবার প্রমাণ হলো।’
খিলগাঁও থেকে ওসমান হাদির জানাজায় অংশ নিতে এসেছেন আবু মুসা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘জুলাইয়ের শক্তি হারিয়ে যায়নি সেটা এই লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে। আমরা লড়ব, প্রয়োজনে জীবন দেব। এতো মানুষের উপস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যদি ওসমান হাদি ভাইয়ের যায়গায় আমি থাকতাম তাহলে ভালো হতো। জুলাই শক্তি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবেই।’
জানাজা নামাজ শেষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি চত্বরে শহিদ শরীফ ওসমান হাদিকে দাফন করা হয়। আর এই বিদায় বেলায়ও কবরের পাশে লক্ষাধিক মানুষ তাকে অশ্রুসিক্ত নয়নে শ্রদ্ধা জানান। এসময় হাদির পরিবার ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। প্রিয়জনকে কবরে শায়িত করার শেষ মুহূর্তে স্ত্রী-স্বজন ও সহকর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর সারাদেশে উৎসবে পরিনত হয়। শিশু, নারী, পুরুষ আপামর সব শ্রেণির মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সেদিন লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতে জনসমুদ্রে রুপ নেয় রাজপথ। এরপর গত এক বছরে দাবি-দাওয়া নিয়ে বেশকিছু আন্দোলন হলেও ৫ থেকে প্রায় ১০ লাখের উপস্থিতি ঘটেনি। ধীরে ধীরে যেন আন্দোলন সংগ্রামে কমতে থাকে লোক সংখ্যা। কিন্তু ওসমান হাদির মৃত্যুর মাধ্যমে তার জানাজা অর্থাৎ বিদায়ক্ষণ যেন আবার সুযোগ করে দিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠ নিয়ে একত্রিত হওয়ার।
এর আগে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদির গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স-কালভার্ট রোডে রিকশায় থাকা হাদির মাথায় খুব কাছ থেকে গুলি করে মোটরসাইকেলে আসা সন্ত্রাসী। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচার শেষে রাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে গত সোমবার সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিঙ্গাপুরে মারা যান আপসহীন এই বিপ্লবী। তবে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনও প্রধান আসামি ফয়সালকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃংখলা বাহিনী।