ঢাকা: নগদবিহীন (ক্যাশলেস) বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিউআর কোড চালু করলেও এতে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এ প্রেক্ষিতে নতুন একটি পরিকল্পনার কথা ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি হচ্ছে- কিউআর কোড ব্যবহারের লক্ষ্যে স্মার্টফোন কেনায় নগদ ভর্তুকি এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে বিশেষ ছাড়।
রোববার (২১ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
পাশাপাশি জন সাধারণের জন্য নির্দিষ্ট স্মার্টফোনে ব্যবহৃত সিমে (সাবস্ক্রাইবার আইডেনটিফিকেশন মডিউল) খরচ কমাতে বৈঠকে কর ও ভ্যাট ছাড়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থাপিত এ প্রস্তাবগুলো পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত আকারে অনুমোদন দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়।
সূত্রমতে, কিউআর কোড ব্যবহার করে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) অ্যাপ দিয়ে নগদবিহীন লেনদেন চালুর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সেবাটি সাধারণ মানুষে কাছে জনপ্রিয়তা পায়নি। প্রান্তিক মানুষ ও সাধারণ গ্রাহকেরা স্মার্টফোন না থাকায় একটা বিশাল জনগোষ্ঠী এ সেবার বাইরে থেকে যায়। পাশাপাশি সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট এবং বাড়তি চার্জের জন্য অনেকে এই সেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন গবেষণায় প্রতিবন্ধকতা হিসাবে দেখানো হয়েছে।
এ ধারাবাহিকতায় নগদবিহীন লেনদেন প্রসারের লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ হিসাবে সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে স্মার্টফোন কেনায় ভর্তুকি এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ কমাতে নগদ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
এছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার এবং মোবাইলের খরচ কমাতে কোম্পানিগুলোকে ভ্যাট ও করেরএকটি বিশেষ ছাড়ের প্রস্তাব করা হয়।
সূত্র জানায়, আগামী ২০২৭ সালের মধ্য নগদবিহীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য কাজ করছে সরকার। এ নিয়ে ক্যাশলেস বা নগদবিহীন বাংলাদেশ প্রচারণা চলমান রয়েছে। মূলত ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আধুনিক অর্থনীতি গড়ে তোলা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যেখানে লেনদেন দ্রুত, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হবে এবং আর্থিক খাতে দুর্নীতি কমবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৭ সালের মধ্যে খুচরা লেনদেনের ৭৫ শতাংশ ডিজিটাল করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যা মোবাইল ফিন্যান্স সার্ভিস, ব্যাংক ও অন্যান্য ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম-এর সমন্বয়ে একটি আন্তসংযোগ ও সাশ্রয়ী ইকোসিস্টেম তৈরির মাধ্যমে অর্জন করতে চায়। মূলত মোবাইল ফিন্যান্স অপারেটর, মাইক্রো ফাইনান্স ইনস্টিটিউশন এবং অন্যান্য আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারীদের একটি একক আন্তঃসংযোগ চ্যানেলের অধীনে আনার জন্য চেষ্টা চলছে। যেখানে ইন্টারঅপারেবিলিটি সিস্টেমের মাধ্যমে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের (আইআইপিএস) মাধ্যমে সহজে টাকা আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু বাংলা কিউআর, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং, কার্ড পেমেন্ট ইত্যাদির ব্যবহারে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে সকল নাগরিকের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে স্মার্টফোন পৌঁছে দেওয়ার অভাবে তা বাস্তবে ফলাফল আশানুরূপ হচ্ছে না।
এ বিষয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর শনিবার (২০ ডিসেম্বর) এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশকে ক্যাশলেস করতে প্রত্যেক নাগরিকের কাছে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে স্মার্টফোন পৌঁছাতে হবে। এ জন্য বিশেষ সুবিধা লাগলে দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যে ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের খুচরা লেনদেনের অন্তত ৭৫ শতাংশ ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। আর শিগগিরই সব সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরে ২৪ / ৭ ‘রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট সিস্টেম’ বা তৎক্ষণাৎ ইলেকট্রনিক ফান্ড স্থানান্তর ব্যবস্থা চালু করা হবে। এতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম আরও সহজ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা না প্রকাশ না করার শর্তে জানান, উচ্চ ইন্টারনেট খরচ, স্মার্ট ডিভাইসের অভাব, ডিজিটাল সাক্ষরতার সীমাবদ্ধতার কারণে ক্যাসলেস বাংলাদেশ গড়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার কম থাকার মতো বিষয়গুলো নগদ লেনদেনের ওপর নির্ভরতা বাড়ায়। আবার বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনেও প্রায়ই নগদ ব্যবহার করা হয়। যাতে ডকুমেন্টেশন, কর বা ব্যাংক তদারকি এড়ানো যায়। তবে ডিজিটাল ওয়ালেট, মোবাইল ব্যাংকিং এবং কিউআর কোড–ভিত্তিক পেমেন্ট ব্যবস্থার প্রসার বাড়াতে পারলে ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়া সফল হবে। এ জন্য স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটে ভর্তুকি দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পেমেন্ট সিস্টেম প্রতিবেদনে অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার ক্যাশলেস বাংলাদেশ (নগদ টাকাবিহীন) গড়ায় জোর দিলেও এখনো দেশের ৭২ শতাংশের বেশি লেনদেন হচ্ছে নগদ টাকায়। বড় অঙ্কের টাকার ক্ষেত্রে মানুষ এখনো নগদ বা চেকের ওপরই বেশি নির্ভরশীল। তবে ছোট ও মাঝারি অঙ্কের লেনদেনের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বাড়ছে। আর প্রতিবছর লগদ লেনদেন কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকা অপব্যয় হয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, একটা প্রচলিত কথা আছে যে, ক্যাশ ইজ কিং। বাস্তবেও তাই। দেশের বেশির ভাগ নগদ লেনদেন অনানুষ্ঠানিক খাতে হয়। এই খাতগুলোকে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থার আওতায় না আনলে ক্যাশলেস সমাজ গড়া কঠিন। যে ভিত্তির ওপর ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ গঠন করার চেষ্টা চলছে, সেই ভিত্তি যদি পুরোনো ধ্যান-ধারণার হয়—যেখানে মানুষ নগদেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। সেখানে এই পরিবর্তন আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
২০২৩ সালের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলা কিউআর’ নামে একটি জাতীয় কিউআর কোড মানদণ্ড চালু করে খুচরা লেনদেনের জন্য। বর্তমানে এই ব্যবস্থায় ৪৩টি ব্যাংক,৫টি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) এবং ৩টি পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) যুক্ত রয়েছে। আর সরকার ২০৩১ সালের মধ্যে সব ধরনের লেনদেনকে ক্যাশলেস করার লক্ষ্য নিয়েছে। যা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ ‘–এর চারটি ধাপ (স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ) বাস্তবায়ন হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো নগদভিত্তিক লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল। ক্যাশলেস অর্থনীতি গড়তে হলে ডিজিটাল অবকাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে। এমনকী অনেক শিক্ষিত মানুষও এখনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে অনীহা দেখান। তবে একবার এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে টাকার মুদ্রণ ব্যয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।