চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার চাঁদাবাজি নিয়ে দেওয়া বক্তব্যে অনড় আছেন নৌপরিবহণ উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেছেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি, স্কেল কমেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে মাফিয়াচক্র আছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম বোট ক্লাবে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) বার্ষিক সাধারণ সভায় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
এর আগে, গত ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে নৌপরিবহণ উপদেষ্টা চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয় বলে অভিযোগ করেন, যদিও টাকার পরিমাণটি তিনি অনুমানের ভিত্তিতে বলেছেন বলে জানান। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক-বর্তমান কোনো মেয়রের নাম উল্লেখ না করে তিনি ‘মেয়র কম, বন্দররক্ষক বেশি’ এমন মন্তব্যও করে তাদেরও জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেন, যা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ বক্তব্যের পর চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন মেয়রের নাম প্রকাশের দাবি জানিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি নৌপরিবহণ উপদেষ্টাকে চট্টগ্রামে ঢুকতে দেবেন না, এমন মন্তব্যও করেছিলেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নৌপরিবহণ উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রথমত আমি বলেছি, অতীতে চট্টগ্রাম বন্দরে চাঁদাবাজি হয়েছে। আমি অতীত কথাটা বলেছি। দুঃখজনকভাবে আমাদের সাংবাদিক ভাইদের কয়েকজন অতীত বাদ দিয়ে এই কথাটা বলেছেন। আমি বর্তমান মেয়র সম্পর্কে কোনো কথা বলিনি। ডা. শাহাদাত অত্যন্ত ভালো মানুষ, আমি উনাকে অনেকদিন ধরে চিনি, উনি আমার অত্যন্ত ক্লোজ মানুষ। উনি পলিটিক্স করেন। অনেকসময় পলিটিশিয়ানরা পুরো কথা না শুনেই বক্তব্য দেন। উনার সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কালকে রাতেও উনি আমাকে ফোন করেছেন। উনি নিজেই দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এরপর উনি উনার ট্যাক্সের বিষয়ে কথা বলেছেন, আমি বলেছি-আমি বিষয়টা দেখব। উনার সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমি উনার কনস্টিটিউয়েন্সির লোকও না।’
চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে অনড় অবস্থান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘অতীত আপনারা ভালো করে জানেন, আমাকে বারবার বলতে হবে না। চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে মাফিয়াচক্র আছে। খুব ডিফিকাল্ট রে ভাই, এটা ‘শেষ করা’ অত সহজ না, আপনারা যেভাবে মনে করেন। এই বন্দরে যে কী ধরনের মাফিয়াচক্র কাজ করে, আপনারা ভালো করে জানেন। আজ বন্দরে এত উন্নতি হয়েছে কেন, এটা অতীতে করতে পারেনি কেন? এই বন্দর তো নতুন করে গড়ে তোলা হয়নি। আর যখনই কোনো কথা বলা হয়, তখন কারও স্বার্থের মধ্যে আঘাত লাগে। আমি অতীত স্বার্থের কথা বলেছি। আমি এ দেশের লোক, বাইরে থেকে আসিনি। নতুন করে আমাকে কিছু করতে হবে না।‘’
‘আমি বলেছি অলমোস্ট সবাই জানে, প্রতিদিন এখানে কত টাকার চাঁদাবাজি হয়। সেটা কে নেয়, কে না নেয় সেটা আমি জানি না। অতীতে স্পন্সরড চাঁদাবাজি হয়েছে বন্দরে। বাংলাদেশে কি চাঁদাবাজি হচ্ছে না? চাঁদাবাজি তো বন্ধ হয়নি, কিন্তু স্কেল কমেছে। আগে সবাই মিলে করত, এখন ইন্ডিভিজ্যুয়ালি করি। আমি নিজে দাঁড়িয়ে দেখেছি, ট্রাক যারা ঢোকায় তাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। এটা শুধু বাইরের লোক করছে তা নয়, ভেতরের লোকও করছে।’
৫৪ বছরে সর্বোচ্চ মুনাফা বিএসসির
সোমবার বার্ষিক সাধারণ সভায় বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আয়-ব্যয় ও মুনাফার হিসাব তুলে ধরেন। তিনি জানান, গেল অর্থবছরে তারা ৩০৬ দশমিক ৫৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন, যা প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৫৪ বছরে সর্বোচ্চ নিট মুনাফা।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদের পরিচালনা আয় ছিল ৫৯০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অন্যান্য খাত থেকে আয় হয়েছে ২০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার মতো। সে হিসাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির মোট আয় প্রায় ৭৯৮ কোটি টাকা। একই অর্থবছরে বিএসসির পরিচালনা ব্যয় ছিল ২৮৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা। প্রশাসনিক ও আর্থিক খাতে গেছে ১২৬ কোটি টাকার মতো। সে হিসাবে, মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪১৬ কোটি টাকা।
সভায় জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিএসসির মোট আয় হয় ৫৯৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ব্যয় হয় ৩১১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। সেবার কর সমন্বয়ের পর ২৪৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকায় দাঁড়ায় নিট মুনাফা। আগের বারের চেয়ে গেল অর্থবছরে (২০২৪-২৫) বিএসসির আয় বেড়েছে প্রায় ৫৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা (প্রায় ২২ শতাংশ)। শেয়ারহোল্ডারদের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নিট মুনাফা থেকে ২৫ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ (ক্যাশ ডিভিডেন্ট) দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সভায় বিএসসির চেয়ারম্যান নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের সচিব নুরুন্নাহার চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।