Tuesday 23 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জকসু নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন
টাকা ছড়ানো ও আপ্যায়নের অভিযোগ প্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে

আবু সুফিয়ান সরকার শুভ, জবি করেসপন্ডেন্ট
২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:০৫

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) নির্বাচন। ফাইল ছবি

ঢাকা: প্রতিষ্ঠার পর প্রথম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রথমে এই নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে উৎসাহ ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা ক্রমেই অনিয়মের অভিযোগে ম্লান হতে শুরু করেছে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে এটি প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ, আবার কারও কাছে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার মুহূর্ত। আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় জকসু’র নির্বাচনি প্রচার যতই জোরালো হচ্ছে, ততই সামনে আসছে অর্থের প্রভাব বিস্তারের নানা চিত্র। ভোট টানতে প্যানেলগুলোর মধ্যে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে টাকা ছড়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে আপ্যায়নের অভিযোগ উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

জকসু নির্বাচনের আচরণবিধিমালায় প্রার্থীদের ব্যয়ের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। বিধিমালা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা এবং হল সংসদের একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নির্বাচনি ব্যয় করতে পারবেন। এই সীমা নির্ধারণের উদ্দেশ্য ছিল অর্থের প্রভাবমুক্ত ও সমান সুযোগভিত্তিক একটি নির্বাচন নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে এই বিধান কার্যত মানা হচ্ছে না বলেই অভিযোগ উঠেছে। বরং, নির্বাচনি প্রচারের আড়ালে অর্থের দাপট ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এমনকি পিআর টিম, বিভিন্ন কার্ড ও লিফলেট ছাপিয়ে দৈনিক বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা প্রচুর টাকা ব্যয় করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

ভোটারদের আপ্যায়নে ব্যস্ত প্যানেলগুলো

নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী, ভোটারদের আপ্যায়ন বা খাবার খাওয়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু চলমান নির্বাচনে এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই বিভিন্ন প্যানেলের পক্ষ থেকে ভোটারদের খাবার খাওয়ানোর একাধিক অভিযোগ সামনে এসেছে। ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থিত আরামবাগ হোটেলে একটি প্যানেলের জিএস প্রার্থী টোকেন সিস্টেম চালু করে ভোটারদের আপ্যায়ন করছেন বলে জানা গেছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হোটেলে গিয়ে সেই জিএস প্রার্থীর নাম বললেই খাবার পাওয়া যাচ্ছে। এখানে ভোটারদের পাঠিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে আরামবাগ হোটেলের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে অনেক শিক্ষার্থী এসেই একজনের নাম বলে খেয়ে যাচ্ছে। আমাদের যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়, সেভাবেই কাজ করি। এর বাইরে কিছু বলতে পারব না।’

এছাড়া, ওয়ারি ও নাজিরাবাজারের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ভোটারদের দলবদ্ধভাবে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়নের ঘটনাও অভিযোগের মধ্যে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হল ও বিভাগের ভিত্তিতে ভোটারদের গ্রুপ করে নির্দিষ্ট সময়ে রেস্টুরেন্টে নেওয়া হচ্ছে। গত দুই সপ্তাহে হল সংসদে ছাত্রদল প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ও অন্যান্য প্রার্থীরা একাধিকবার ওয়ারির রেস্টুরেন্টে হল সংসদের প্রায় শতাধিক ভোটারকে দলবদ্ধভাবে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়ন করিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব আয়োজনের ব্যয় আচরণবিধিতে নির্ধারিত সীমার তুলনায় অনেক বেশি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এই ব্যয় একজন প্রার্থীর অনুমোদিত বাজেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার প্রশ্নই আসে না।

আপ্যায়িত এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘পদপ্রার্থী এক আপু আমাদের ওয়ারিতে রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের সঙ্গে আরও অনেকেই ছিলেন।’

এদিকে, আপ্যায়নের পাশাপাশি ভোটারদের মধ্যে নগদ অর্থ সরবরাহের প্রলোভন দেখানোর অভিযোগও উঠেছে। একাধিক শিক্ষার্থী দাবি করেছেন, নির্দিষ্ট প্যানেলের হয়ে কাজ করার জন্য এবং ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে কিছু প্রার্থী বা তাদের কর্মীরা সরাসরি নগদ অর্থ দেওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছেন। এমনকি শিক্ষার্থী অবস্থান করা মেসগুলোতে উপহার সামগ্রী সরবরাহের অভিযোগও রয়েছে।

ভোট টানতে এলাকাভিত্তিক পার্টির আয়োজন

ভোট টানতে জেলা ছাত্রকল্যাণ ও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এলাকাভিত্তিক পার্টি ও প্রোগ্রামের আয়োজন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটকসহ ক্যাম্পাসের বাইরের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে ছোট-বড় পার্টি আয়োজন করা হচ্ছে, যেখানে খাবার, উপহার ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এসব আয়োজনের উদ্দেশ্য ভোটারদের নির্দিষ্ট প্যানেলের পক্ষে অবস্থান নিতে উৎসাহিত করা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এসব পার্টি ও প্রোগ্রামের মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করা হচ্ছে এবং অর্থের মাধ্যমে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চলছে। এতে নির্বাচন ক্রমেই আদর্শভিত্তিক প্রতিযোগিতা থেকে সরে গিয়ে অর্থনির্ভর প্রতিযোগিতায় পরিণত হচ্ছে। বেশিরভাগ প্রোগ্রামই ছাত্রদলের অর্থায়নে হচ্ছে বলে জানা যায়।

এদিকে, শিবির-সমর্থিত ‘অদম্য জবিয়ান ঐক্য’ প্যানেলের বিরুদ্ধেও কৌশলে অর্থ ছড়িয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থীদের আপ্যায়নের ক্ষেত্রে তারা ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপভিত্তিক আপ্যায়নের পর ভাউচার দেখালেই শিবিরের পক্ষ থেকে নগদ অর্থ সরবরাহ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আপ্যায়িত হওয়া একাধিক শিক্ষার্থী সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, সরাসরি যাতে কেউ ধরতে না পারে, সে জন্য শিবির এই কৌশল অবলম্বন করছে।

এ ছাড়া ভোটার টানতে শিবিরের পক্ষ থেকেও প্যানেলের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে বিজয় দিবসে ‘বিজয় র‍্যালি’ বা নৌ র‍্যালির আয়োজন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, এই র‍্যালির মাধ্যমে ভোটারদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার ও শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, র‌ালিকে কেন্দ্র করে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়েছে। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্যানেলের নামেই এসব প্রচার করা হয়েছে।

‘সাংবাদিক নামধারী’ ও পেইজ পরিচালনাকারীদের অর্থ প্রদান

নির্বাচনি প্রচারে তৃতীয় পক্ষ ব্যবহারের অভিযোগও ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। ‘সাংবাদিক নামধারী’ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন পেইজ পরিচালনাকারীদের অর্থ প্রদান করে নির্দিষ্ট প্যানেলের পক্ষে প্রচার চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, এসব ব্যক্তি ও পেইজ অর্থের বিনিময়ে একপক্ষীয় সংবাদ, পোস্ট, ভিডিও ও স্ট্যাটাস প্রকাশ করছেন। এমনকি বিভিন্ন প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও অপতথ্য ছড়িয়ে নির্বাচনি পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগও উঠেছে। ছাত্রদল ও শিবির— উভয়প্যানেলই এসব পেইজকে অর্থায়ন করে এসব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন প্রার্থীর অভিযোগ, এসব প্রচারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্যানেলগুলোকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে এবং প্রতিপক্ষকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে এবং নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সাংবাদিকতার নামে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব কাজে লাগিয়ে অর্থের বিনিময়ে পক্ষপাতমূলক প্রচার চালানো শুধু নির্বাচন আচরণবিধির লঙ্ঘন নয়, পেশাগত নৈতিকতারও পরিপন্থী। এসব পেইজ ও তথাকথিত সংবাদ প্রচারের কারণে প্রকৃত তথ্য চাপা পড়ে যাচ্ছে। ফলে ভোটাররা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ হারাচ্ছেন।

এদিকে এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আচরণবিধি থাকলেও তার কার্যকর প্রয়োগ ও নজরদারি দৃশ্যমান নয়। প্রকাশ্যে অনিয়ম ঘটলেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রার্থীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, জকসু নির্বাচন মানে নেতৃত্ব বাছাইয়ের সুযোগ। কিন্তু যদি টাকা, খাবার আর সুবিধাই ভোটের প্রধান হাতিয়ার হয়, তাহলে যোগ্য নেতৃত্ব আসবে কীভাবে?

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জবি শাখা শিবিরের সেক্রেটারি এবং শিবির-সমর্থিত অদম্য জবিয়ান ঐক্য প্যানেলের জিএস প্রার্থী আব্দুল আলিম আরিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে ভোটারদের আপ্যায়নের অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। সেকেন্ড গেটেই দেখা যাবে কারা ভোটারদের আপ্যায়ন করছে। আর নির্বাচনি ব্যয়ের নিয়ম কেউই তো মানছে না। নির্বাচন কমিশন ১৫ হাজার টাকার কথা বললেও বিভিন্ন প্যানেলে একজন ডোনারই ৫০ হাজার টাকা করে ডোনেশন দিচ্ছে।’ বহিরাগতদের নিয়ে বিজয় র‍্যালির ভিডিও ফুটেজ নির্বাচনি প্রচারের অংশ ছিল কি না?- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বহিরাগত শিবির সমর্থকেরা আমাদের সমর্থন দিয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদল-সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ জবিয়ান প্যানেলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মিডিয়া উপ-কমিটির সমন্বয়ক ও শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. শাহরিয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আপ্যায়নের বিষয়গুলো প্রার্থীদের ব্যক্তিগত বিষয়। এ বিষয়ে আমরা অবগত নই। জেলা ছাত্রকল্যাণের প্রোগ্রামগুলো তারা করেছে, এর সঙ্গে ছাত্রদলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’ নিজেদের পক্ষে প্রচারে বিভিন্ন ফেসবুক পেইজ ও সাংবাদিক নামধারীদের বিষয়ে অভিযোগ করা হলে তিনি, ‘এর কোনো সত্যতা নেই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক কানিজ ফাতেমা কাকলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। আমরা তো পুলিশের মতো কাজ করতে পারব না। নির্বাচনি আপত্তিসংক্রান্ত বিষয় সমাধানে আলাদা কমিটি আছে। আমাদের কাছে তথ্য-প্রমাণসহ কেউ অভিযোগ করলে আমরা সেগুলো তাদের কাছে পাঠাব। তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।’

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর