সিলেট: সিলেট মহানগরীতে স্মার্টফোন চুরি যেন এখন নিত্যদিনের ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ফোন হারাচ্ছেন বাস, বাজার, শপিং মল কিংবা জনবহুল এলাকায়। এত বিপুল সংখ্যক চোরাই মোবাইল যাচ্ছে কোথায়—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে উদ্ঘাটিত হয়েছে, চোরাই স্মার্টফোনের দুটি বড় আড়ৎ দীর্ঘদিন ধরে চলছিল সিলেটের প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজার এলাকায়—একটি সিটি হার্ট শপিং সেন্টার এবং অপরটি সিলেটের বৃহত্তম মোবাইল মার্কেট নামে পরিচিত করিম উল্লাহ মার্কেট।
পুলিশ জানায়, গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ সুরমার মোমিনখলায় তানভীরের বাসায় অভিযান চালিয়ে মো. সুজ্জাত (২৭)-এর কাছ থেকে ৩৮টি বৈধ কাগজপত্রবিহীন মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে, এসব ফোন বাজারে ছাড়ার নির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল।
এরপর ভোর ৪টার দিকে দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী জৈনপুর এলাকায় মো. আব্দুস শহিদ ও তার ভাতিজা আকরাম আলী (২১)-কে আটক করে ডিবি। তাদের বাসা থেকেই উদ্ধার হয় মোবাইল ফোন, পেনড্রাইভ, স্ক্রু-ড্রাইভার ও একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা—যা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, চোরাই পণ্য সংগ্রহ, মেরামত ও বিক্রির একটি সু-সংগঠিত নেটওয়ার্ক সক্রিয় ছিল।
আটক ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পুলিশ অভিযান চালায় কোতোয়ালী মডেল থানাধীন বন্দরবাজারের সিটি হার্ট শপিং সেন্টারে। সেখানে ‘তোহা টেলিকম’ নামের একটি দোকান থেকে উদ্ধার করা হয় ২০৪টি অবৈধ কাগজপত্রবিহীন চোরাই মোবাইল ফোন—যার বাজারমূল্য প্রায় ২৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব ফোন প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছিল। প্রশ্ন উঠছে—শপিং মলের মতো জনসমাগমপূর্ণ জায়গায় এতদিন ধরে কীভাবে চলছিল এমন অবৈধ ব্যবসা?
একই দিন বিকেল ২টায় করিম উল্লাহ মার্কেটের ৩য় তলায় অবস্থিত ‘স্মার্টফোন গ্যালারি’তে অভিযান চালিয়ে আরও ১৫৪টি চোরাই মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। দোকানের কর্মচারী ফারুক আহমদ (৩৪)-এর উপস্থিতিতেই এসব ফোন উদ্ধার হলেও, দোকান মালিক বা সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা কী ছিল—সে প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর এখনও মেলেনি।
পুলিশ জানিয়েছে, আটক হওয়া আব্দুস শহিদের বিরুদ্ধে সিলেট মহানগর পুলিশের বিভিন্ন থানায় হত্যা, ছিনতাই, চুরি ও অন্যান্য অপরাধে একাধিক মামলা রয়েছে। এত মামলার পরও তিনি কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি অবৈধ ব্যবসা চালাতে সক্ষম হলেন—এ প্রশ্নও উঠেছে।
করিম উল্লাহ মার্কেট থেকে মোবাইল ক্রয় করে এক ভুক্তভোগী সারাবাংলাকে বলেন, এখানে যারা পুরোনো (সেকেন্ড হ্যান্ড) মোবাইল ব্যবসা করেন তারা সবাই গ্রুপিং করে ব্যবসা করেন। মার্কেটের ভিতরে রয়েছে তাদের বিশাল সিন্ডিকেট। এখানে পুরোনো (সেকেন্ড হ্যান্ড) মোবাইল ফোনের কোনো গ্যারান্টি নেই। টাকা দিয়ে পণ্য বুঝে নেওয়ার পর তার আর দায়ভার দোকানদার নেয় না। এ নিয়ে নিত্যদিন এই মার্কেটে ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা দেখা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ক্রেতা বলেন, ‘এখানে অনেক দামি ও ভালো ব্যান্ডের মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। আমি এর আগে এখান থেকে মোবাইল কিনেছি, সেটা ভালো চলছে কিন্তু এসব মোবাইল চোরাই কিনা আমরা জানি না। বিক্রির সময় দোকানদার এসব মোবাইল বিদেশি বলে দাবী করেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিক্রেতা বলেন, ‘আমরা এসব মোবাইলগুলো সংগ্রহ করি বিভিন্ন পার্টির মাধ্যমে। তারা এখানে এসে দিয়ে যায়। আমরা কোথাও গিয়ে নিয়ে আসি না। বেশিরভাগ মোবাইল আসে চট্রগ্রাম থেকে।’
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং চোরাই মোবাইল চক্রের সঙ্গে জড়িত অন্যদের শনাক্তে তদন্ত অব্যাহত আছে।
তবে নগরবাসীর প্রশ্ন—চোরাই মোবাইলের বাজার যদি এতটাই খোলামেলা হয়, তবে ভুক্তভোগীরা নিরাপত্তা পাবে কোথায়? আর কতদিন চোখের সামনেই চলবে এমন অবৈধ বাণিজ্য?
উদ্ধারকৃত চোরাই ফোন ফেরত দিতে চায় পুলিশ:
এদিকে, পুলিশের বিশেষ অভিযানে উদ্ধারকৃত চোরাই ফোন ফেরৎ দিতে ঘোষণা করেছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি)।
উদ্ধার করা ৪২২টি চোরাই মোবাইলের মধ্যে ২৩৯টি মোবাইলের আইএমইআই (IMEI) নম্বর শনাক্ত করা হয়েছে। গত রোববার গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
ডিবি পুলিশ জানায়, যেসব ভুক্তভোগী নাগরিক তাদের হারানো বা চুরি যাওয়া মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর নিচে প্রকাশিত তালিকায় খুঁজে পাবেন, তাঁদেরকে যথাযথ প্রমাণসহ যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।