Wednesday 24 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১৫ দফা সুপারিশ
জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানোর মূল বাধা সুশাসনের ঘাটতি: টিআইবি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৮:৫৯ | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:৫৬

ঢাকা: রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার ও বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অব্যাহত কৌশলগত প্রাধান্য ও অতিনির্ভরশীলতাই নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুশাসনের ঘাটতি, নীতিগত অবহেলা এবং স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত “বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়” শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রান্তিক পর্যায়ে রেখে জীবাশ্ম জ্বালানি লবির স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে, যার ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে একটি টেকসই ও স্বচ্ছ জ্বালানিব্যবস্থা গড়ে তুলতে ১৫ দফা সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পেশ করেছে টিআইবি।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা, নির্বাহী-ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। টিআইবির এনার্জি গভর্নেন্স বিভাগের কোঅর্ডিনেটর নেওয়াজুল মওলা এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর আশনা ইসলাম প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।

আমূল পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি করা হলেও বাস্তবে বিদ্যুৎ খাত এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভরশীল উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে স্বার্থের দ্বন্দ্বপুষ্ট নীতিদখলের মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অতিনির্ভরশীলতা সৃষ্টি করা হয়েছে, এর ফলে একদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উত্তরণের যে সম্ভাবনা ও অঙ্গীকার আছে তা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না এবং অন্যদিকে জীবাশ্মনির্ভরতা অধিকতর স্থায়ীত্ব লাভ করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাজেট বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় একেবারেই নগণ্য। নীতিগতভাবে প্রাধান্যের দিক থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত যথাযথ গুরুত্ব পায়নি বরং অবহেলিত হয়েছে। জ্বালানি খাতের নীতি- কৌশল ও পরিকল্পনায় নানাবিধ অসঙ্গতি অস্পষ্টতা তৈরি করা হয়েছে। বিশেষত, সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) জীবাশ্ম জ্বালানি লবির প্রভাবে জীবাশ্ম জ্বালানিকে কেন্দ্র করে প্রণীত, যে কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে নীতিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে বাস্তবিক নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিবর্তে অপরীক্ষিত তথাকথিত “গ্রিন এনার্জি”-কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।’

ভূমি স্বল্পতাকে নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উপাদনের বাধা হিসেবে যুক্তি দেখানোকে বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে যতটুকু বিনিয়োগই হয়েছে তাতেও বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম এবং অর্থের অপচয়, যোগসাজশনির্ভর দুর্নীতির দৃষ্টান্ত আমরা গবেষণার আওতাভুক্ত প্রকল্পগুলোতে দেখেছি। পতিত চোরতন্ত্রের আমলে দেশের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের একটি জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ খাত। এখানে ক্যাপাসিটি চার্জ এবং অন্যান্য প্রতারণামূলক যোগসাজশের মাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল এবং একই রোগ নবায়নযোগ্য খাতেও সংক্রমিত হতে দেখেছি। ভূমি ক্রয়, অধিগ্রহণ ও সংশ্লিষ্ট ক্ষতিপূরণের নামে যে অনিয়মের চর্চা অন্যান্য অবকাঠামো খাতে হয়ে থাকে সেই একই চিত্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতেও দৃশ্যমান। নীতিগতভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে প্রাধান্য না দেওয়ার কারণে এটি আশঙ্কা করা অমূলক নয় যে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ নেট-জিরো নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর মহাপরিকল্পনা অবিলম্বে ঢেলে সাজিয়ে এর মূল ধারায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর প্রাধান্যের কৌশল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের অন্যতম উপায় হিসেবে একটি স্বাধীন তদারকি কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।’

গবেষণায় দেখা গেছে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’-এর অপব্যবহার করে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের পরিবর্তে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে উচ্চ ট্যারিফে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি করা হচ্ছে, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি। এছাড়া, সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয় প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে গড়ে দেড় গুণ বেশি দেখিয়ে প্রায় ২ হাজার ৯২৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। গবেষণার আওতাভুক্ত মাত্র পাঁচটি প্রকল্পেই ভূমি ক্রয় ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে ২৪৯ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে। এই দুর্নীতির টাকা ভাগাভাগি হয়েছে আইপিপি কর্মকর্তাবৃন্দ, স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মী এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্যদের একাংশের মধ্যে।

গবেষণায় উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের বিদেশি বিনিয়োগের ৯৬.৭ শতাংশই যাচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে, আর নবায়নযোগ্য খাতে মাত্র ৩.৩ শতাংশ যা একদিকে যেমন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবেও আত্মঘাতী। দেশি-বিদেশি লবির প্রভাবে বাতিল হওয়া কয়লাভিত্তিক প্রকল্প পুনরায় চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের পরিপন্থী। মূলত নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত এখন কর্পোরেট উদ্যোক্তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

গবেষণায় উঠে আসা দুর্নীতির চিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)-এর হিসাব অনুযায়ী সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রতি মেগাওয়াটে ৮ কোটি টাকা প্রয়োজন হলেও গবেষণার আওতাভুক্ত ৬টি প্রকল্পে গড়ে ১৩.৮ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। অর্থাৎ মোট ২ হাজার ৯২৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করা হয়েছে। এছাড়া ভূমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে আইপিপির কর্মকর্তাদের একাংশ, ইউনিয়ন ও উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের সমস্যা উত্তরণে টিআইবির ১৫ দফা সুপারিশের অন্যতম হলো জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বিদ্যমান জ্বালানি মহাপরিকল্পনা অনতিবিলম্বে বাতিল করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস এবং জ্বালানি মিশ্রণে নবানয়নযোগ্য জ্বালানির পরিমাণ বৃদ্ধি- এমন মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে নতুন একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি ও কার্যকর করা; নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫সহ বিদ্যমান সকল নীতি ও পরিকল্পনায় অভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন; বিদ্যুৎ আইন ২০১৮ এর সংশোধন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আইনি ভিত্তি প্রদান এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের/বিকল্প গ্রিডের মাধ্যমে সঞ্চালন, সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান; শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকদের নেট মিটারিং সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন সহজীকরণ, ফিড-ইন-ট্যারিফ কার্যকর এবং তাদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রণোদনা প্রদান; জ্বালানি খাতে নীতি করায়ত্ত বন্ধ এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রতিরোধসহ এ খাত সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন; সকল প্রকার জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ত্রুটিমুক্ত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও যাচাই নিশ্চিত করা; নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর-সংক্রান্ত কার্যক্রমে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য স্রেডাকে একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা প্রদানসহ এর কারিগরি, জনবল এবং অবকাঠামোগত সক্ষমতা বৃদ্ধি; বিপিডিবির কার্যক্রমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনকে অগ্রাধিকার প্রদান; স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টিসহ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)Ñএর আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগ এবং নবায়নযোগ্য খাতের প্রযুক্তির জন্য বিদেশ নির্ভরতা কমানো এবং এখাতের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকরি উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি। উল্লেখ্য, এই গবেষণার আওতাভুক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে ২০০৮ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত আইন, নীতি, পরিকল্পনা ও বিধি-বিধান এবং ২০১২ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত সুশাসনের নির্দেশকের ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা, অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণ।

সারাবাংলা/ইউজে/এসআর
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর