রংপুর: ভয়ের ছায়া নিয়ে শুরু হয় ভোর, রাত গভীর হলে আতঙ্ক আরও ঘনীভূত হয়। প্রকাশ্যে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই আর ডাকাতির ঘটনায় রংপুর যেন ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে অপরাধের নগরীতে। পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র তিন মাসে জেলায় সংঘটিত হয়েছে ১৩টি হত্যাকাণ্ড ও ৩৭টি ধর্ষণ, সব মিলিয়ে ৮৯৯টি অপরাধ। এই সংখ্যা শুধু সংখ্যাই নয়, এর পেছনে রয়েছে হাজারো পরিবারের কান্না। একের পর এক খুন আর ধর্ষণের ঘটনায় জেলা শহর ও গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এদিকে অপরাধ দমনে পুলিশের পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন মহল।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ মাসে সংঘটিত ৮৯৯টি অপরাধের মধ্যে রয়েছে- হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ, চুরি এবং শারীরিক নির্যাতনের মতো ঘটনা। বিশেষ করে শহর ও শহরতলিতে প্রকাশ্যে সশস্ত্র ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাবোধ মারাত্মকভাবে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
এই পরিসংখ্যান মানুষকে আরও বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। জেলা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ক্রিস্টোফার হিমেল রিছিল পরিসংখ্যানের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘অপরাধ প্রবণতা নিয়ে আমাদের নজরদারি রয়েছে। তবে এটা সত্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে হত্যা ও নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে।’
এই আতঙ্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে তারাগঞ্জ উপজেলা। গত ৬ মাসে এখানে ঘটেছে ৫টি হত্যাকাণ্ড। এর মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ছিল দলিত সম্প্রদায়ের ২ যুবক- রুপলাল দাস ও প্রদীপ দাসকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। আগস্ট মাসে সংঘটিত এই ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
রুপলালের স্ত্রী ভারতী রায় বলেন, ‘আমার স্বামী কোনো চোর ছিল না। শুধু দরিদ্র আর দলিত বলেই তাকে মেরে ফেলা হলো। আমরা ন্যায়বিচার চাই, কিন্তু পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় বিশ্বাস হারাচ্ছি। কতদিন আর এমন অবিচার সহ্য করব?’
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ৭ ডিসেম্বর তারাগঞ্জে ঘটে আরেকটি নির্মম ঘটনা-বীর মুক্তিযোদ্ধা দম্পতির নৃশংস হত্যাকাণ্ড। মাত্র আট হাজার টাকার লোভে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়।
ভুক্তভোগী পরিবার জানায়, ‘আমার বাবা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু আজ তাকে এভাবে হারাতে হলো। আমি পুলিশের সদস্য হলেও নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে পারলাম না। এই অপরাধের শিকড় কোথায়? সমাজ কি আর মানবিকতা হারিয়েছে?’
এই প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শুধু রংপুর শহর নয়, গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দারাও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। শহরতলির বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘রাত হলে রাস্তায় বের হওয়া যাচ্ছে না। দিনদুপুরেও ছিনতাই হচ্ছে। পুলিশি টহল বাড়ানো দরকার।’
জেলায় ধর্ষণের সংখ্যা বাড়তে থাকায় সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে নারীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক গৃহবধূ বলেন, ‘আমরা নারীরা আর নিরাপদ বোধ করি না। রাতে বাড়ি থেকে বের হওয়া মানে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা। গত কয়েক মাসে একের পর এক খুন আর ধর্ষণের খবর শুনে আমাদের হৃদয় ছিন্নভিন্ন। কখন কী হয়ে যায়, কে জানে?’
কলেজছাত্রী আয়েশা আক্তার বলেন, ‘প্রতিদিন ধর্ষণের খবর শুনে বাইরে যেতে ভয় লাগে। গণপরিবহনেও নিরাপদ বোধ করি না। ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা ভীষণ শঙ্কিত।’
এদিকে রংপুরে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে স্থানীয় মানবাধিকতার সংগঠনগুলো বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করছে। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ মাহামুদুল হক বলেন, ‘ধর্ষণের মামলাগুলো দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে নিষ্পত্তি, সাক্ষ্য আইন সংস্কার এবং ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কঠোর আইনশৃঙ্খলা পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার এবং দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
মানবাধিকার বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি নিছক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা নয়, বরং গভীর সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির সাবেক মানবাধিকার কর্মকর্তা ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহামুদুল হক বলেন, ‘এটি কেবল আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা নয়, বরং এটি সমাজে গভীর সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। দলিত সম্প্রদায় ও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর সংঘটিত হামলাগুলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবিক মূল্যবোধের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত ও কার্যকর বিচার নিশ্চিত করা না গেলে মানুষের আইনের প্রতি আস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।’
রংপুরের পুলিশ সুপার মারুফাত হুসাইন বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে আছি। সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আমরা দ্রুত তদন্ত করে আসামিদের গ্রেফতার করেছি। অপরাধপ্রবণ এলাকায় বিশেষ অপারেশনও চলছে।’
তবে স্থানীয়রা বলেছেন, অপরাধীদের ধরতে পুলিশের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের ধীর গতিতে সাড়া, তদন্ত দীর্ঘসূত্রতা এবং ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না।