রাজশাহী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)–এর প্রাণিবিদ্যা জাদুঘরে পা রাখলেই যেন চোখের সামনে খুলে যায় প্রাণিজগতের এক বিস্ময়কর ইতিহাস। স্বচ্ছ কাচের জার ও বাক্সে সারিবদ্ধভাবে সংরক্ষিত হাজার হাজার প্রাণির নিথর দেহ—কোনোটি মমি করা, কোনোটি আবার ফরমালিনে ডুবিয়ে রাখা। দুর্লভ ফসিল থেকে শুরু করে বনরুই, সজারু, উদবিড়াল, বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির সাপ, সামুদ্রিক প্রাণী, এমনকি মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ—সব মিলিয়ে এ জাদুঘর যেন জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য সমাহার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্রাণিবিদ্যা জাদুঘরে গেলে দেখা মিলবে দুর্লভ ফসিল, বনরুই, সজারু, উদবিড়াল, বিলুপ্ত হওয়া নানা প্রজাতির সাপ, মানবদেহের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, পরিফেরা থেকে ম্যামালস প্রজাতির হাজার হাজার নমুনা। কোনোটি সংরক্ষিত আছে শুকনো অবস্থায় মমি করে, আবার কোনোটিকে ফরমালিনে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। স্বচ্ছ কাচের বাক্স ও জারে সারিবদ্ধভাবে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে তাদের। জাদুঘরের দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধা রয়েছে বিভাগের শিক্ষকের তোলা বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ছবি।

দেয়ালজুড়ে ঝুলছে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকদের তোলা বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আলোকচিত্র। আর সারি সারি আলমারিতে সাজানো সংরক্ষিত নমুনাগুলো নীরবে সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রকৃতির বৈচিত্র্য, বিবর্তন আর বিলুপ্তির ইতিহাসের।
গবেষণার জন্য অনন্য, অথচ অজানা
দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রাণিবিদ্যা জাদুঘর রয়েছে, তবে এত বড় পরিসর, এত বৈচিত্র্য আর এত সমৃদ্ধ সংগ্রহ কোথাও নেই। ফলে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জাদুঘর শিক্ষার্থীদের কাছে এক অনন্য সহায়ক ক্ষেত্র। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পার হলেও এই জাদুঘরের কথা আজও বহু মানুষের অজানা—এমনকি রাবির অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীও জানেন না এর অস্তিত্ব সম্পর্কে।

বিশাল এ জাদুঘরটি অবস্থিত রাবির স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু অ্যাকাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায়। ১৯৭২ সালে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রয়াত শিক্ষক মুস্তাফিজুর রহমানের উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এর নামকরণ করা হয় ‘অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’।
শুক্র ও শনিবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি পাঁচদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। অনুমতি সাপেক্ষে এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হলেও প্রচারের অভাবে সমৃদ্ধ এই সংগ্রহ আজও লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে।

কী আছে এই জাদুঘরে
এ জাদুঘরে একই সঙ্গে দেখা মিলবে নানা প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায়সহ ১ হাজার ৫৪৩টি প্রাণীর প্রক্রিয়াজাত দেহ। এসব প্রাণীর পাশাপাশি ১৪২টি ফসিলও রয়েছে এ জাদুঘরে, যা বর্তমানে দুর্লভ। সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণির পাশাপাশি রয়েছে নানা জাতের সামুদ্রিক মাছ, বিরল প্রজাতির জীবন্ত ফসিল, পেট্রোমাইজন ও মেক্রিনসহ ১৯ প্রজাতির ৩৩টি কোরাল এবং ৪৫ ধরনের মলাস্কার সেল।

শুধু বন্য ও গৃহপালিত পশু নয়, দুটি মানবকঙ্কালও রয়েছে এখানে। একটি পুরুষের আর অপরটি নারীর। আরও আছে হাতি, ঘোড়া, কুমিরের কঙ্কাল, শুশুক ও ডলফিনের মমি। ছোট ছোট কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে শজারু, বনরুই, বিভিন্ন প্রজাতির বিড়াল, মাছরাঙা, মিঠাপানির মাছ, সামুদ্রিক মাছ, কোরাল (প্রবাল) এমনকি মানবভ্রূণও। মলাস্কা, পরিফেরা, নিডারিয়া, কর্ডাটা, আর্থ্রোপোডা, নেমাটোডাসহ প্রায় সব পর্বের বিচিত্র রকমের প্রাণীর সমাহার জাদুঘরটিতে। শুধু বাংলাদেশেরই নয়, দেশের বাইরে থেকেও নিয়ে আসা হয়েছে কিছু দুর্লভ প্রাণি। এছাড়া শুধু রাজশাহী নগর ও সংলগ্ন এলাকা থেকে এ পর্যন্ত ৯৬ প্রজাতির মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে।

জাদুঘর হলেও কক্ষটির মাঝখানে টেবিল-চেয়ার ও রাসায়নিক পরীক্ষার সামগ্রীও রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বিভাগের ব্যবহারিক ও গবেষণার কাজ করা হয় এখানে।
মিউজিয়াম অ্যাটেনডেন্ট কেতাব আলী জানান, জাদুঘরটি এতটাই সমৃদ্ধ যে একে বাংলাদেশের প্রাণিবিদ্যার ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় বলা হয়। তবে বাস্তবতার দিকটি ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘বিচিত্র প্রজাতির প্রাণি সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ফরমালিন নেই। দক্ষ ট্যাক্সিডার্মিস্টের অভাব রয়েছে। প্রদর্শনের জন্যও পর্যাপ্ত জায়গা নেই।’
দীর্ঘদিন ধরে পাখি নিয়ে গবেষণা করা প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুজ্জামান মো. সালেহ্ রেজা বলেন, ‘এই মিউজিয়ামের সংগ্রহ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বিলুপ্তপ্রায় জীবাশ্মসহ বিপুলসংখ্যক স্থলজ, জলজ ও সামুদ্রিক প্রাণি এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। সংগ্রহের দিক থেকে এটি দেশের অন্যতম সেরা মিউজিয়াম।’
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম জানান, ‘পরিফেরা থেকে ম্যামালস—প্রাণীজগতের প্রায় সব পর্বের সংগ্রহ এখানে রয়েছে। দেশের প্রাণীবিজ্ঞানী ও বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞরাও এই মিউজিয়ামকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘জায়গার সংকট ও পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে জাদুঘরটিকে আধুনিকায়ন করা যাচ্ছে না। যথাযথ প্রকল্প ও অর্থায়ন পেলে এটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা জাদুঘরে রূপ নিতে পারে।