Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রেসক্রিপশন সহজবোধ্য হবে আর কবে!


১৭ জুলাই ২০১৮ ০৮:২৩

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: গত ২৭ জুন ডায়রিয়া আক্রান্ত ৯ মাসের মেয়েকে নিয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান গণমাধ্যমকর্মী মাহমুদুল হাসান রাজু। চিকিৎসক  পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছু ওষুধ লিখে দেন। কিন্তু সাতটি ফার্মেসিতে গিয়েও সেই ওষুধ কিনতে পারেননি রাজু। কোনও ফার্মেসিতেই বিক্রেতা চিকিৎসকের লিখে দেওয়া ওষুধের নাম বুঝতে পারছিলেন না। নিরুপায় হয়ে ফের হাসপাতালে গিয়ে ওষুধের নাম জেনে নিতে হয় রাজুকে।

বিজ্ঞাপন

কেবল মাহমুদুল হাসান রাজু নয়, গত কয়েকদিনে এমন আরও অনেককেই খুঁজে পাওয়া গেছে যারা চিকিৎসকের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ কিনতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন। অথচ উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে- প্রেসক্রিপশন হাতে লেখা হলেও তা পড়ার উপযোগী করে স্পষ্ট অক্ষরে এবং বড় বা ছাপার হরফে লিখতে হবে। কিন্তু সেই নির্দেশনার প্রতিপালন হচ্ছে কতটুকু-তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন ভুক্তভোগীরা।

গত বছরের ৯ জানুয়ারি চিকিৎসকদের স্পষ্ট অক্ষরে পড়ার উপযোগী করে প্রেসক্রিপশন লেখার নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। একইসাথে ৩০ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সার্কুলার জারি করার নির্দেশও দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রার ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েনের (বিএমএ) সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর একই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএমডিসি এবং গত ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। অথচ চিকিৎসকরা উচ্চ আদালতে এই নির্দেশনা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তি মেনে চলছেন না। ফলে অস্পষ্ট অক্ষরে হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন নিয়ে এক ফার্মেসি থেকে আরেক ফার্মেসিতে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের।

বিজ্ঞাপন

নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে মাহমুদুল হাসান রাজু সারাবাংলা’কে বলেন, ‘যে হাসপাতালে গিয়েছিলাম, সেই হাসপাতালের ওষুধ কোম্পানির নাম লিখেছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু কোনোভাবেই আমি ওষুধটির নাম বুঝতে পারছিলাম না। মগবাজার, শান্তিনগর, কাকরাইল এলাকার সাতটি ফার্মেসিতে ঘুরেও ওষুধটির নাম জানতে পারলাম না, কিনতেও পারলাম না। কোনো বিক্রেতাই ওষুধটির নাম বুঝতে পারছিলেন না।’

মাহমুদুল হাসান আরও বলেন, ‘ওষুধ বিক্রেতারা বলেন, এত ছোট বাচ্চা বলে অন্য কোনো কোম্পানির ডায়রিয়ার ওষুধ দিয়েও তারা কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিলেন না। এমনকি শান্তিনগর এলাকার এক ফার্মেসিতে একটি ওষুধ কোম্পানির একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ উপস্থিত ছিলেন। তিনিও ওই ওষুধের নাম বুঝতে পারেননি।’

পরে প্রেসক্রিপশনের ছবি হাসপাতালটির ফেসবুক পেজে শেয়ার করে আমার ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন মাহমুদুল হাসান। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওষুধের নাম বলে দেয়। এমন অভিজ্ঞতা যেন অন্য কারও না হয়, সে জন্য ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছেন, জানান মাহমুদুল।

পান্থপথের আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে সংগ্রহ করা হয় এমন দুর্বোধ্য হাতে লেখা কয়েকটি প্রেসক্রিপশন। এর একটি হাতে ছিল ৫৫ বছরের জাব্বার হোসেন খানের কাছে। তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, ‘প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বসে আছি। একবার ওষুধের দোকানে গিয়েছিলাম, ফেরত এসছি। এখন আবার এসছি চিকিৎসকের কাছে নাম জানার জন্য। যখন সুযোগ হবে, তখন তার রুমে যাব।’

জাব্বার হোসেন খান বলেন, এভাবে ভোগান্তি আর সহ্য হয় না। ওষুধ বিক্রেতা যদি ওষুধের নাম বুঝতে না পারে, তাহলে রোগীরা যাবে কোথায়?

কেবল বেসরকারি হাসপাতাল নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ মগবাজার ও শাহবাগের ফার্মেসিগুলো ঘুরেও প্রেসক্রিপশন নিয়ে একই চিত্র পাওয়া গেছে। একাধিক ওষুধ বিক্রেতা সারাবাংলা’কে বলেন, হাতের লেখা বুঝতে না পেরে অনেক ক্রেতাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হন তারা। সুযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে ফোন দিয়ে ওষুধের নাম জেনে তা বিক্রি করেছেন, এমনও জানালেন কয়েকজন বিক্রেতা।

স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সারাবাংলা’র কাছে স্বীকার করেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তির পরও প্রেসক্রিপশন নিয়ে ভোগান্তি কমেনি রোগীদের।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রেসক্রিপশনে ‍দুর্বোধ্য লেখার কারণে অনেকে ভুল ওষুধ সেবন করছেন। আর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর জানিয়েছে, ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে অভিযোগ জমা পড়েছে ১ হাজার ১০২টি। আবার ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব মেডিসিনের (আইওএম) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৭ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন চিকিৎসকদের লেখা প্রেসক্রিপশনে থাকা ওষুধের নাম বুঝতে না পেরে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলা’কে বলেন, আদালতের নির্দেশনা মানতে আমরা বাধ্য। সে হিসেবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি চিকিৎসকদের স্পষ্ট এবং বড় হরফে প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য। রোগীদের কোনো ধরনের ভোগান্তি আমরা চাই না। আর সেটা যদি চিকিৎসকদের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন নিয়ে হয়, তাহলে বিষয়টি আরও দুঃখজনক। স্বাস্থ্য অধিদফতর এ বিষয়ে নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে বলে জানান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ।

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও রোগীদের এমন ভোগান্তি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্ববায়ক অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব।

তিনি বলেন, যারা ওষুধ বিক্রি করবেন তারাই যদি ঠিকমতো ওষুধটির নাম বুঝতে না পারেন, তাহলে তারা ঠিক ওষুধ দেবেন কিভাবে! যারা একটু সচেতন, তারা হয়তো ক্রেতাদের ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু যারা অসৎ, তারা তো ভুল ওষুধ দিয়ে দেবে। আর আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র ও নিরক্ষর। তারা তো বিনা সংকোচে সেই ফার্মেসির দেওয়া ওষুধ খেতে থাকবেন।

বিষয়টিকে অত্যন্ত ভয়ংকর অভিহিত করে অধ্যাপক রশীদ-ই মাহবুব বলেন, সরকারি ও বেসরকারি- সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে প্রেসক্রিপশন লেখার পদ্ধতি এখন সময়ের অন্যতম দাবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ওষুধ প্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সীতেশ চন্দ্র বাছার সারাবাংলা’কে বলেন, “প্রেসক্রিপশনের দুর্বোধ্য লেখা ‘ফ্রিকোয়েন্টলি’ হচ্ছে। অথচ এর কোনো প্রতিকার নেই। কারণ, এ সর্ম্পকিত সব তথ্য আমাদের কাছে কিংবা সাংবাদিকদের কাছে আসে না।’

তিনি বলেন, “রোগী ও ওষুধ বিক্রেতা পর্যায়েই বিষয়টি শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফার্মেসিতে যেসব ওষুধ বিক্রেতারা অভ্যস্ত, তারা হয়তো অনেক সময় এর সমাধান করতে পারেন। কিন্তু নতুনরা তো সেটা পারেন না। তারা ‘মিসইন্টারপ্রেট’ করেন।”

মন্ত্রণালয়ের ‍নির্দেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে এ সংক্রান্ত এক বৈঠক হয়েছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘ওই বৈঠকে আমরা বলেছিলাম, ওষুধের জেনেরিক নাম লিখে কিংবা বড় হাতের অক্ষরে লিখে বা কম্পিউটার প্রিন্ট করে প্রেসক্রিপশন তৈরি করে এর সমাধান করা সম্ভব। তাই পরিষ্কার করে বড় হাতের অক্ষরে যেন চিকিৎসকরা লিখেন- এ বিষয়ে সবাই একমত হবেন কিনা সে বিষয়ে দ্বিধা থাকলেও মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে আর সেটি বেশি দূর যায়নি বলেই মনে হয়।’

সারাবাংলা/জেএ/টিআর

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর