বদলে যাচ্ছে ‘ঢাকা শিশু হাসপাতাল’
১৯ জুলাই ২০১৮ ০৮:১৬
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে দেশের প্রথম ডিজিটাল হাসপাতাল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে ‘ঢাকা শিশু হাসপাতাল’। চব্বিশ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ডিজিটাল হাজিরা মেশিন, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আসন বৃদ্ধি, হাসপাতালের প্যাথলজি ভবন সম্প্রসারণ, অভিযোগ বক্স স্থাপন, হাসপাতালের ভেতরে শিশুপার্ক তৈরি, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা— সব মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে হাসপাতালটি। যা সরকারি এই হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বৃদ্ধি করবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন থেকে এখানে তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করবেন চিকিৎসকরা। এরইমধ্যে বসানো হয়েছে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন। যেখানে সবাইকে কার্ড পাঞ্চ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হাজির হতে হয়। আবার চলে যাওয়ার সময়ও পাঞ্চ করতে হয়।
হাসপাতালের কর্মচারী আলামিন হোসেন সারাবাংলাকে জানান, হাসপাতালটিতে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৫০০ মতো রোগী আসেন, যার মধ্যে ভর্তি হতে চান ৮০০ রোগী। কিন্তু ৫০ শয্যার আইসিইউ মিলে প্রায় ৬০০ জনের মতো রোগী ভর্তি করানোর সক্ষমতা রয়েছে হাসপাতালটির। তাই কোনো রোগী যেন এখানে এসে ফেরত না যায় সেজন্য হাসপাতালের বেড বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। এজন্য তিন তলা প্যাথলজি ভবনটিকে ৯ তলা পর্যন্ত করা হচ্ছে। ওই ভবনটি ৯ তলা পর্যন্ত ফাউন্ডেশন দেওয়া আছে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ভবন করা হচ্ছে।
হাসপাতালটির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (এনআইসিইউ) দায়িত্বে রয়েছেন আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, ‘৫০টি আইসিইউতে বেড না পেয়ে অনেকে সন্তানকে নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন। তাই কর্তৃপক্ষ আইসিইউতে সিট বাড়াতে যাচ্ছেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এখানে আরও ৬০টি সিট বৃদ্ধি করা হবে।’
এরইমধ্যে ঢাকা শিশু হাসপাতাল এবং পঙ্গু হাসপাতালের মধ্যে থাকা পরিত্যক্ত ফাঁকা জায়গায় হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসকের উদ্যোগে পার্ক করা হয়েছে। পার্কে দুই ধরনের দোলনা, স্লিপার, শিশু ও অভিভাবকদের জন্য বসার জায়গা করা হয়েছে। লাগানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছ। বিকেল ৩টা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কটি খোলা থাকে।
রোগী ও রোগীর স্বজনরা যাতে প্রতারিত হতে না পারে সেজন্য অভিযোগ বক্স খোলা হয়েছে। কেউ অভিযোগ করলে তা সমাধান করা হয়। একইসঙ্গে রোগী ভাগিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য হাসপাতাল চত্বরে সবসময় অনুমোদনহীন অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও এখন তা আর থাকতে দেন না কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে হাসপাতালের বিভিন্ন খাত থেকে আয় হলেও সেখানে বিভিন্ন খরচ দেখিয়ে আয়-ব্যয় সমান দেখানো হতো। অনেক সময় ঘাটতি দেখানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকেই হাসপাতালটির আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফার্মেসি, প্যাথলজি ও ভর্তির টাকা স্বচ্ছভাবে ব্যাংকে জমা দেখানো হয়, এখন অযথা খরচ দেখানো হয় না।’
গত তিন বছর হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে কাজ করছেন নাঈমা রহমান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকছেন। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে যেকোনো সময় করা হচ্ছে। আবার কর্মচারীরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করাতে হাসপাতালটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নও থাকছে আগের চেয়ে বেশি। তাদের প্রতি তদারকি বেড়েছে, বেড়েছে ক্যান্টিনের মান।’
গত বছরগুলোতে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল টেন্ডারের মাধ্যমে অর্থ জালিয়াতির। ভুয়া টেন্ডার বানিয়ে হাসপাতালে ফান্ড থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ থাকলেও সেখানে এখন ই-টেন্ডার করা হচ্ছে।
এতোদিন বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে কষ্ট হলেও সেবাগ্রহীতাদের সুবিধার্থে কিছুদিনের মধ্যেই ম্যাসেজিং সিস্টেম চালু হতে যাচ্ছে। কোনও পরীক্ষার রিপোর্ট প্রস্তুত হলে মোবাইল নম্বরে ম্যাসেজ চলে যাবে। আবার হাসপাতালের বিল সহজে পরিশোধের জন্য মোবাইল ফোন কোম্পানি রবি ও গ্রামীণ ফোনের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে, তাতে করে বিকাশ অথবা রকেটের মাধ্যমে সহজেই রোগীরা বিল পরিশোধ করতে পারবে।
জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল আজিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সততা, নিষ্ঠা আর ন্যায়পরায়ণতার সাথে রোগীদের সেবার ব্রত নিয়ে বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, ফুলের বাগান, বাচ্চাদের খেলার স্থান হিসেবে শিশুকানন, বাংলাদেশের প্রথম শিশু সার্জিক্যাল আইসিইউ তৈরি, এমএস ও এমডিদের বকেয়া বেতন প্রদানসহ দিগুণ বেতন প্রদান, দক্ষ ডাক্তার তৈরি ও আধুনিক প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ড এর সাতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা, পদোন্নতি প্রদানের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার উন্নতি, ডিজিটাল যুগে শিশু হাসপাতালকে ডিজিটাল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তিনি জানান, আগামী ছয় মাসের মধ্যে অনেকগুলো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। সেগুলো হলো- ঢাকা শিশু হাসপাতাল নাসিং ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা, কিডনি প্রতিস্থাপন (Transplantation) বিভাগ চালু, অত্যাধুনিক অপারেশন কমপ্লেক্স চালু, শিশু ক্যান্সার সার্জারি বিভাগ চালু ও শিশু থোরাসিক (Thorasic) সার্জারি বিভাগ চালু করা।
এছাড়া আগামী ২ বছরের মধ্যে আরও কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। সেগুলো হলো- ৬৬০ বেড থেকে ১ হাজার ৫০০ বেডে রূপান্তরের মাধ্যমে ঢাকা শিশু হাসপাতালকে এশিয়ার বৃহত্তম শিশু হাসপাতালে পরিণত করা, এনআইসিইউ কমপ্লেক্স (NICU complex) তৈরি করা, নিওনাটাল সারজিক্যাল ওয়ার্ড (Neonatal Surgical ward) তৈরি করা।
পরিচালক ডা. আব্দুল আজিজ আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সবার সহযোগিতায় ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বদলে যাবে। আধুনিক, ডিজিটাল এবং মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে ঢাকা শিশু হাসপাতাল।’
সারাবাংলা/ইউজে/এমও