স্ট্রবেরি চাষে সাফল্যের স্বপ্ন
২২ জুলাই ২০১৮ ০৯:৪২
।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: জয়পুরহাট সদরের কৃষক মামুনুর রশিদ। কয়েক বছর ধরেই স্ট্রবেরি চাষ করে আসছেন। দেখেছেন সাফল্যের মুখও। শুধু চারা বিক্রি করেই গত বছরে তার লাভ হয়েছে লাখ টাকা। এ বছরেও চারা বিক্রি করছেন তিনি। তাতে তার লক্ষ্য অন্তত দেড় লাখ টাকা লাভ। এসব চারা বিক্রি শেষে পরে একই জমিতে আবারও তিনি চারা তৈরি করবেন। পরে সেই চারা দিয়ে তিন বিঘা জমিতে চাষ করবেন স্ট্রবেরি। গত বছরে লাখ খানেক টাকা লাভ হলেও এবার কয়েক লাখ টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
স্ট্রবেরি দিয়েই লাভের স্বপ্ন দেখছেন রাজশাহীর চরঘাটার বাবু ইসলামও। সারাবাংলা’কে বাবু বলেন, গত বছর আধা বিঘা জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করেছি। ৬০ হাজার টাকা খরচ করে দেড় লাখ টাকা লাভ হয়েছে। এবার আরও বেশি জমিতে স্ট্রবেরি লাগানোর ইচ্ছে রয়েছে। তিনি বলেন, এখন চারা তৈরি চলছে। নভেম্বরের দিকে স্ট্রবেরি চাষ শুরু হবে। একই এলাকার কৃষক আব্দুল লতিফও জানালেন একই কথা। তারা বলছেন, স্ট্রবেরি চাষ এখন গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।
কেবল রাজশাহী বা জয়পুরহাট নয়, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারেও শুরু হয়েছে স্ট্রবেরি চাষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে রাজশাহী, বগুড়া ও জয়পুরহাটে। ফলটি পচনশীল হওয়ায় সবাই হয়তো লাভবান হতে পারছেন না, তবে অনেক কৃষকই দেখছেন লাভের মুখ।
জয়পুর হাটের কৃষক মামুনুর রশিদ সারাবাংলা’কে বলেন, ‘বর্তমানে প্রতি পিস চারার দাম ৩০ থেকে ৩৫ থেকে টাকা। আর চারা তৈরিতে খরচ পড়ে ১৮ থেকে ২০ টাকা। প্রতি পিস চারাতে গড়ে অন্তত ১৫ টাকা লাভ থাকে।’
তিনি বলেন, গত বছর কিছু স্ট্রবেরি নষ্ট হলেও চারাতে লাভ হয়েছিল এক লাখ টাকা। এবার নতুন জমিতে স্ট্রবেরি লাগাব। কৃষি অফিস থেকে বলা হয়েছে, একই জমিতে বারবার স্ট্রবেরি হয় না। গত বছর এ কারণেই স্ট্রবেরি ভালো হয়নি। তবে এর আগের আগের বছরগুলোতে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা করে লাভ হয়েছিল।
এদিকে, স্ট্রবেরি চাষকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। গত বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি স্ট্রবেরির তিনটি উচ্চফলনশীল জাত এবং উন্নত উদ্ভাবন কৌশল উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো সফলভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ হচ্ছে। এ ছাড়াও মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মীরা প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি কৃষি অর্থনীতি বিভাগ ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রবেরির প্রতিটি গাছে ৪০টি ফল ধরে। প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ২ হাজার ৭৭৮ কেজি ফলন হয়। প্রতি কেজি স্ট্রবেরির উৎপাদন খরচ প্রায় ৪২ টাকা। আর সেটা বিক্রি করা যায় প্রায় একশ টাকায়। সেই হিসাবে এক বিঘা জমিতে এক লাখ টাকা খরচ করে স্ট্রবেরি চাষ করে অন্তত ৩ লাখ টাকা লাভ হতে পারে। এসব বিবেচনায়, স্ট্রবেরি চাষ খুবই লাভজনক বলে দাবি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের।
গাজীপুরে থাকার সময় স্ট্রবেরি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ড. মুন্সী রাশীদ আহমদ। বর্তমানে তিনি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। সারবাংলা’কে ড. রাশীদ বলেন, গত বছর খাগড়াছড়িতে স্ট্রবেরির কিছুটা চাষ হয়েছে। এবারও চেষ্টা করছি। কয়েকবছর আগে এখানে স্ট্রবেরির বেশ চাষাবাদ হয়েছিল। সামনে যদি ভালো কোনো প্রযুক্তি দেখানো যায়, ভালো ফলন আসে; তবে কৃষকেরা আবারও কিছুটা উদ্বুদ্ধ হতে পারে।
তিনি বলেন, স্ট্রবেরির মার্কেটিং নিয়ে সমস্যা আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে বেশি দাম নেওয়া হয়। এটা যদি না হতো তাহলে স্ট্রবেরির চাষাবাদ আরও প্রসারিত হতো।
এক প্রশ্নের জবাবে এই কৃষি বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, খাগড়াছড়িতে সমান জমি, নদীর ধার ও এর আশেপাশে স্ট্রবেরির চাষাবাদ হয়ে থাকে। সামগ্রিকভাবে দেশে এর চাষাদের কী অবস্থা— জানতে চাইলে ড. রাশীদ বলেন, ‘এটি পচনশীল ফল। উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে মার্কেটিং করতে না পারলে কৃষকের ক্ষতি হয়। সবমিলিয়ে প্রসপেক্ট খুব একটা ভালো নয়। কোনো কৃষক এক বছর চাষাবাদ করলে পরে সে আর আগ্রহ দেখায় না।’
তবে দেশে স্ট্রবেরি চাষের বড় সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদ। তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, ‘যারা বিভিন্ন সময়ে দেশের বাইরে যায়, বাইরে থেকে ফলটি দেখে আসে; তারা বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে। সবার মধ্যে না হলেও বিশেষ একটি শ্রেণির মধ্যে এই ফলের চাহিদা রয়েছে। এসব বিবেচনায় দেশে স্ট্রবেরির চাষাবাদ শুরু হলে প্রথমে হোচট খেতে হয়েছে। এখন আমরা নিজেরা জাত উদ্ভাবন করেছি। অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। কৃষকেরা আগের চেয়ে আরও বেশি চাষাবাদ করছে। তবে স্ট্রবেরি চাষাবাদ নিয়ে আরও বেশি গবেষণা প্রয়োজন।’
প্রসঙ্গত, স্ট্রবেরি রসালো ও পুষ্টিকর ফল। রঙ, গন্ধ ও স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় এটি সারাবিশ্বে সমাদৃত। ফলটি রবি মৌসুমে চাষের উপযোগী। দেশের আবহাওয়ায় আশ্বিন মাসই (মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর) স্ট্রবেরির রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে গাছে ফুল আসতে শুরু করে এবং ডিসেম্বরের শেষ ভাগ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর