এইচএসসি-তে ফল বিপর্যয়: ইতিবাচক ধারায় ফেরার এখনই সময়
২৩ জুলাই ২০১৮ ১৩:১৬
।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: গত ১০ বছরের মধ্যে এবারই উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় পাশের হার সর্বনিম্ন। একইসঙ্গে কমেছে জিপিএ-৫-এর সংখ্যাও। সরকারের নির্বাচনী বছর হওয়া সত্ত্বেও ফলাফলের এমন নিম্নগতিকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে মান সম্পন্ন শিক্ষায় ঘাটতি থাকায় তার খেসারত দিতে হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে এসে। এর রেশ থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও। তাদের দাবি, বাজারের মানহীন নোট-গাইডের ওপর অতিমাত্রার নির্ভরশীলতাও এমন ফলাফলের কারণ। আর এই প্রশ্নে ইতিবাচক ধারায় ফেরার এখনই সময়।
১৯ জুলাই মাদ্রাসা ও কারিগরিসহ মোট ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন ২০১৮ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল ঘোষণা হয়। পাসের হার ৬৬.৬৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ হাজার ২৬২ জন। গত এক দশকের মধ্যে পাসের হার ও জিপিএ-৫-এ এটিই সর্বনিম্ন।
এদিকে, পাসের হার নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই বলে দাবি করেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, পাসের হার বাড়লো কি কমলো, জিপিএ-৫ কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো- সেটি সরকারের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। আমরা চাই কোয়ালিটি এডুকেশন। পরীক্ষার হলের স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রেখেই পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। তাতে যে ফল এসেছে তাতেই আমরা সন্তুষ্ট।
পাসের হার কমার পেছনে পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোট ও গাইডের ওপর বেশি নির্ভরতাকে দায়ী করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। সেইসঙ্গে তারা বলছেন, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় দুর্বলতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তিও খারাপ ফলাফলের পেছনে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
এ বিষয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, কলেজগুলোতে এখন পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোট বই ও বিভিন্ন নোট-শিটের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। পাঠ্যবই তেমন পড়ানো হয় না। এতে করে শিক্ষার্থীরা এখন নোট-শিটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা যখন পড়ালেখা করেছি তখন নতুন বই পেলে গল্প ও ছড়াগুলো আনন্দ নিয়ে পড়তাম। এমনকি পরের দিন কোন অধ্যায় শিক্ষক পড়াবে, তা আগের দিন পড়ে রাখতাম। যেখানে বুঝতাম না যে লাইন টিক দিয়ে রাখতাম। কিন্তু এখন শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই পড়তে চায় না। পরীক্ষায় পাসের জন্য বিভিন্ন নোটের ওপর নির্ভর করে বসে থাকে। এতে করে শিক্ষার্থীরা পাস করছে, কিন্তু প্রকৃত মেধাবী হচ্ছে না।
রাজধানীর অন্যতম সেরা কলেজ ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস এবারের ফলাফলে খুব বেশি হতাশ নন জানিয়ে সারাবাংলা’কে বলেন, পাবলিক পরীক্ষায় কোনো বছর ফল ভালো হবে, আবার কোনো বছর খারাপ হবে এটিই নিয়ম। তবে দেখা উচিত শিক্ষার্থীদের ভিত মজবুত হচ্ছে কি না। যদি তাদের বেসিক দুর্বল হয় সেটি নিশ্চয়ই চিন্তার বিষয়।
এ ছাড়া নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত রোজারিও বলছেন, অতীতে পাবলিক পরীক্ষাগুলোয় প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে রেকর্ড গড়েছিল এবারের পরীক্ষায় সেটি বন্ধ হওয়ায় পাসের হারে প্রভাব পড়েছে। তার মতে, সাময়িকভাবে এ ফলাফলে বিপর্যয় আসলেও দীর্ঘমেয়াদে সেটি ইতিবাচক। কেননা এর মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।
পাসের হার কমলেও এটিকে শিক্ষার সুষ্ঠু ধারা হিসেবে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিকও। তার মতে, এবারে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় যে ফল হয়েছে, সেটিই বরং স্বাভাবিক। গত প্রায় এক দশক পরীক্ষার ফলে যেটি হয়েছে তা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর গণমানুষের অনীহার বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছে। জিপিএ-৫-এর ছড়াছড়ি ছিল। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে পারেনি। সুতরাং পাসের হার বাড়িয়ে, জিপিএ-৫ বাড়িয়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যায় না।
আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর মতে, এ বছর উচ্চ-মাধ্যমিকের ফলাফল নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বরং এটি এবার স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে এসেছে। তিনি বলেন, পরীক্ষায় নকল প্রতিরোধ, খাতা মূল্যায়নে স্বচ্ছতা আনা এবং উচ্চ-শিক্ষার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের গড়তে গিয়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড পথে যেতে হবে আমাদের। আমার মনে হয়ে সেটি এখন শুরু করার সময় এসেছে।
সারাবাংলা/এমএস/টিআর