ডাস্টবিনের জীবন
২৮ জুলাই ২০১৮ ০৮:৪৯
।। আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ডাস্টবিন দেখেই ওড়না মুখে শক্ত করে চেপে ধরেন সুমনা। এই র্বজ্য পেরিয়েই অফিস যেতে হবে। কিন্তু ডাস্টবিনের দুর্গন্ধময় পথটাকে তিনি এড়িয়ে চলতে চান। গা ঘিনঘিনে পরিবেশ। সাদা সাদা পোকা ময়লার ভেতর থেকে বের হয়ে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। দেখেই বমি আসছে তার। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ময়লা ট্রাকে তোলায় গন্ধটা বিকট আকার ধারণ করেছে।
ঢাকা শহরের প্রতিটি অলিগলিতে নিত্যদিনের চিত্র এটি। ছোটখাটো থেকে মাঝারি ধরনের এ ডাস্টবিন শহরের সব জায়গায় লক্ষ্য করা যায়। মানুষ হঠাৎ এর সামনে এসে পড়লে গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য কত কিছুই না করে। কিন্তু কিছু মানুষের জীবন কাটে এই ডাস্টবিনকে ঘিরে। তারা হচ্ছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। নিজেরা ময়লা আর গন্ধের মধ্যে ডুবে থেকে শহরকে ময়লা আর গন্ধমুক্ত রাখেন।
প্রতিদিন গভীর রাতে শহরের আবর্জনা পরিষ্কারের মধ্য দিয়ে তাদের ডিউটি শুরু হয়, চলে সকাল ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত।
তীব্র দুর্গন্ধের মধ্যে বসেই কাজের ফাঁকে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন তারা। চারিদিকে ময়লার স্তূপ। গা ঘিনঘিন করা সাদা পোকারা ঘুরছে তার মধ্যে। এমন একটি জায়গায় গেলেই যেখানে আমার গা গুলায়, তীব্র গন্ধে বমি উঠে আসে; ঠিক সেই জায়গাতে বসেই খাওয়া-দাওয়ার কাজটিও সেরে ফেলেন এসব পরিচ্ছন্নতাকর্মী, সেখানে বসেই আড্ডা দেন তারা।
ডাস্টবিনের পাশে বসেই সারাবাংলা প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী অনিল কুমারের (৪২)।
তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, আমার জম্মের পর থেকে এই ডাস্টবিনকে দেখছি। আমার বাবা ডাস্টবিনের ময়লা, আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ করতেন, এখন আমি করি। আমার কাছে কোনো গন্ধ লাগে না, অরুচিও ধরে না। আমরা এখানে বসে খাবার খাওয়া থেকে শুরু করে সব কাজ করি।
অনিল বলেন, এই কাজ করার জন্য মাঝে মাঝেই আমাদের শরীরে বিভিন্ন চর্মরোগ দেখা দেয়। অসুখ বিসুখ হয়। তবু আমাদের এ কাজ করে যেতে হয়। কারণ আমরা না করলে এই শহরকে কে পরিস্কার করবে?
বাবু বাজার এলাকার ডাস্টবিনের পরিছন্ন কর্মী তোতা মিয়া (৬০) বলেন, আমাদেরকে পাঁচজনের কাজ তিনজনে করতে হয়। আট ঘন্টার ডিউটি ১৬ ঘণ্টা করতে হয়। আমাদের ঈদ, পূজা, নেই। সরকার থেকে যা বেতন পাই ভাল চলে। কিন্তু বয়স হচ্ছে কাজ আর আগের মতো কাজ করতে পারি না। অবসরের সময়ে এককালিন টাকার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়। সারাজীবন এ ময়লা আবর্জনায় কাজ করলাম তার বিনিময়ে শেষ বয়সে এসে কিছু পাবো না বলে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
বাংলাবাজার এলাকার ডাস্টবিনের পরিছন্ন কর্মী আবুল কালাম (৩৫) সারাবাংলাকে বলেন, আমি আমার জম্মের পর থেকে এ কাজ করে আসছি। এর আগে আমার বাবা এ কাজ করতেন এখন আমি করি ভবিষৎতে আমার ছেলে করতে পারে। ডাস্টবিন পরিস্কারের কাজ আমি জম্মগতভাবে পেয়েছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সারাবাংলাকে জানান, তাদের কোন সাপ্তাহিক ছুটি নেই। ৩৬৫ দিনেই ডাস্টবিনের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে হয়। কোনো অসুখ-বিসুখ হলেও তাদের কাজে আসতে হয়। নতুবা জরিমানা হয়ে যায়।
গুলিস্তান এলাকার পরিছন্ন কর্মী রুস্তুম আলী (৪৫) সারাবাংলাকে বলেন, সমাজের মানুষ আমাদের ছোট চোখে দেখে। নিম্নশ্রেণির মানুষ বলে হেয় করে। মাঝে মধ্যে মনে হয় এ সমাজে আমাদের কোনো মূল্য নেই। তারপরও আমি আমার কাজকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। কে কি বলল আমার যায় আসে না। গুলিস্তানে এক ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তিনি বাস করেন।
তার কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও তিনি এ কাজে তার ছেলেকে আসতে দিতে চান না। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে আমি লেখাপড়া শেখাচ্ছি। তাকে এই কাজ করতে দেব না।
পরিচ্ছনতাকর্মীদের অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পরিছন্নতাকর্মীদের সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। কারণ তারা নো ওয়ার্ক, নো পেমেন্ট পদ্ধতিতে কাজ করে। অর্থাৎ কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক। কিন্তু মানবিক দিক থেকে, যদি তাদের কেউ অসুস্থ হয় তাহলে ছুটি তারা পায়। এছাড়া ছুটির প্রয়োজন হলে বিকল্প কাউকে দিয়ে তারা ছুটি পায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্জ্য সংগ্রহের সময় যাতে কোনো সংক্রমণ না হয় সে জন্য তাদেরকে হ্যান্ডগ্লাভস এবং বিশেষ জুতা প্রদান করা হয়। সবকর্মী এগুলো পেয়ে থাকে। এছাড়া তারা অসুস্থ হলে বিনামূল্য সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকে।’
‘পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য কোনো পেনশন কিংবা অবসরকালীন সময়ে অর্থ প্রদানের নিয়ম করপোরেশনের দিক থেকে নেয়। তবে কেউ যদি তাদের অবসরকালীন সময়ে তাদের ছেলে-মেয়েকে এ কাজে চাকরির আবেদন করে তাহলে তা বিবেচনায় নেওয়া হয়। এছাড়া তাদের কেউ মারা গেলে করপোরেশনের পক্ষ থেকে ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে। ভবিষ্যতে তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে’ বলেন ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা।
সারাবাংলা/এআই/একে