‘আমার সহপাঠিকে মেরে ফেলা হয়েছে, প্রতিবাদও করতে দেওয়া হচ্ছে না’
৩০ জুলাই ২০১৮ ২১:১৩
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: সোমবার সকাল ১০টা। শিক্ষার্থীরা এসেছিলেন শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে। পুলিশ তাদের দাঁড়াতেই দিচ্ছিল না। ঘৃণায় ক্ষোভে চলে যাচ্ছিলেন শিক্ষর্থীরা। আর ধিক্কার দিচ্ছিলেন, ‘ছি! আমার ভাই আমার সহপাঠিকে মেরে ফেলা হয়েছে। আর আমাদের প্রতিবাদ করতেও দেওয়া হচ্ছে না।’
কিছুক্ষণ পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানাতে ব্যারিকেড দেয় আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তায়। ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে পুলিশ আসে প্রায় ২০০ জন। শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে তারা। যেখানে পড়েছিল দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিমের নিথর মরদেহ। উত্তরাগামী বাসগুলোকে জোর করে থামিয়ে তুলে দেওয়া হয় বিক্ষোভকারীদের।
পুলিশ যখন শিক্ষার্থীদের জোর করে বাসে উঠিয়ে দিচ্ছিল তখন শিক্ষার্থীরা চিৎকার করে বলছিল, আমার ভাইকে ফেরত দিতে পারবেন। আমার ভাই-বোন মরেছে। আমরা প্রতিবাদ করতে এসেছি অথচ সেখানে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
সে সময় পুলিশ এক শিক্ষার্থীকে হুমকি দিয়ে বলে, ‘তোমাকে থানায় নিয়ে গিয়ে পেটানো হবে। রাজনৈতিক মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। এখান থেকে সরে যাও।’
জানা গেছ, শিক্ষার্থীদের জোর করে বাসে তুলে দেওয়ার পর শেওড়া এলাকায় গিয়ে বাস থেকে নেমে যায় শিক্ষার্থীরা। এরপর বিএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জড়ো হয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় গুলশান ডিগ্রি কলেজ, নৌকাহিনী কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলজ, ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ, উত্তরা হাই স্কুল ও গুলশান কমার্স কলেজের শিক্ষার্থীরা। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা একসঙ্গে রাস্তায় নেমে যায়। সে সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় পুলিশকে।
পরে শিক্ষার্থীদের একটি দল রমিজ উদ্দিন স্কুলের সামনের সড়কে অবস্থান নেয়। সেনা সদস্য, স্কুলের শিক্ষকগণ, র্যাব ও পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুরোধেও তারা সড়ক ছাড়তে রাজি হননি।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বিচার চাই, বিচার চাই, ছাত্র হত্যার বিচার চাই, আমার মায়ের কান্না-আর না, আর না বলে শ্লোগান দিতে থাকে।
বেলা ১১টার দিকে এপিসি কার ও জলকামান দিয়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে আসলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। জলকামানে লাথি মারতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা। সে সময় তারা ভুয়া ভুয়া বলেও শ্লোগান দিতে থাকে। পরে সেখানে উপস্থিত সেনা কর্মকর্তা ও র্যাব-১ এর সিও সারওয়ার বিন কাশেমের হস্তক্ষেপে জলকামান পিছিয়ে গেলে শান্ত হয় শিক্ষার্থীরা।
এদিকে রাস্তা অবরোধের ফলে বিমানবন্দর সড়কের দুদিকেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রয়োজনের তাগিদে ছুটে চলা মানুষজন গাড়িতে থেকে নেমে পায়ে হাটতে শুরু করে। অনেক রোগীকেও হেটে হেটে কুর্মিটোলা হাসপাতালের দিকে যেতে দেখা যায়। আবার রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ও সিএনজিগুলোকে সহায়তা করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীরাই রোগীবাহী ওই সব সিএনজি ও অ্যাম্বুলেন্সকেগুলোকে এগিয়ে দেয়।
দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে রাজধানীর শেওড়া এলাকায় রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। এতে কমলাপুর ও বিমানবন্দরগামী সব ধরণের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মোজাম্মেল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ট্রেন চলাচলও স্বাভাবিক হবে বলেও জানান তিনি।
বেলা ২টার দিকে বৃষ্টি শুরু হলেও সড়ক থেকে সরে যাননি শিক্ষার্থীরা। চলতে থাকে তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচি।
এরপর দুপুর ২টার দিকে শিক্ষার্থীদের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন রমিজ উদ্দিন কলেজের ছাত্র সাইদুল ইসলাম আপন। এ সময় তিনি ৯ দফা দাবির কথা তুলে ধরে বলেন, ‘এই ৯ দফা দাবি পুরণে আগামী ৭ দিনের আল্টিমেটামসহ নৌমন্ত্রীকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে বলে দাবি করেন।
আন্দোলন চলাকালে দুদিকের রাস্তায় বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকারসহ সব ধরনের যানবাহন বন্ধ থাকে। দুএকটি মোটরসাইকেল যাতায়াত করতে চাইলে সেটিও চলতে দেয়নি বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এমনকি পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীর অফিসারদের গাড়িও চলতে দেয়নি শিক্ষার্থীরা। মাঝে মধ্যে প্রেসের গাড়িও আটকে থাকতে দেখা গেছে। মিরপুর থেকে উত্তরাগামী সব যানবাহন আটকে দেওয়া হয়।
অবরোধের সময় হেঁটে চলা সাধারণ লোকদের কাছে আজকের ভোগান্তির ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেটের ফ্লাইট মিস করা আরজু আরা শিমিন সারাবাংলাকে বলেন, শুধু অবরোধে পড়ার কারণেই ফ্লাইটটা মিস হয়েছে। তবুও চাই আর কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়।
কুর্মিটোলায় চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন উর্মিলা। তিনি বলেন, ভোগান্তি হচ্ছে সবার, আমারও। বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী মারা গেছে। এটা তো অন্যায়। তাদের বিচার হোক এটাই চাই।
বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন আব্বাস আলী খান। তার বাবার হজ্জ ফ্লাইট ছিল দুপুরের পর। অবরোধের কারণে তিনি যেতে পারেননি। জনগণের রাস্তা বন্ধ করে এ ধরণের অবরোধ সঠিক নয় বলেও জানান তিনি।
বেলা পৌঁনে ৩টার দিকে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের ১২ জনকে ডেকে নেন রমিজ উদ্দিনের শিক্ষকরা। প্রায় ঘণ্টাখানেক বৈঠক করার পর শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসেন। ইংরেজী বিভাগের শিক্ষিকা উম্মে কুলসুম আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের বলেন, ড্রাইভার ও হেলপার আটক হয়েছে। আমরাও তাদের ফাঁসি চাই। কিন্তু প্রসেস মানতে হবে। আমি কথা দিচ্ছি তাদের ফাঁসি হবে। তোমরা ভুল তথ্য প্রচার করছ। ৬ জন শিক্ষার্থী মারা যায়নি। মারা গেছে ২ জন। ১০জন শিক্ষার্থীকে সিএমএইচ এ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে দুজন গুরুতর ছিলেন। তারাও এখন ভাল আছেন।
তিনি আরও বলেন, জাবালে নুর পরিবহন এই রাস্তা দিযে আর কোনদিন চলাচল করবে না। নিহতদের পরিবারকে সহায়তা করা হবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে একটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। তোমরা ফাঁসি চাইছ আমরাও চাচ্ছি। তবে এটা একটি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তোমরা রাস্তা ছেড়ে দাও। আজ তোমরা মানুষের অনেক ক্ষতি করেছো। অনেকে ফ্লাইট মিস করেছে। পুরো ঢাকা শহর অচল হয়ে আছে।
শিক্ষার্থীরা শিক্ষিকা উম্মে কুলসুমের কথা না শোনায় তিনি রাগে সেখান থেকে চলে যান। এরপর পৌনে চারটার দিকে পুলিশ অ্যাকশনের প্রস্তুতি নেয়। আস্তে আস্তে শিক্ষার্থীদের সামনের দিকে যেতে বলে পুলিশ। বাজি বাজাতে শুরু করলে শিক্ষার্থীরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং পুলিশকে লক্ষ করে দুএকজন ঢিল মারতে শুরু করে। এসময় পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা ধাওয়া দেয়। ধাওয়া দিয়ে শেওড়া এলাকা পার করে দেয় পুলিশ।
বিকেল চারটার দিকে যান চলাচল শুরু হলে প্রভাতী বনশ্রী গাড়ির চালক আবু বকর বলেন, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উত্তরার দিকে যেতে যেতে গাড়ি ভাংচুর করেছে। কয়েকশ গাড়ি ভেঙ্গেছে বলে অভিযোগ করেন ওই গাড়িচালক।
সাড়ে চারটার দিকে গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সাধারণ মানুষের অনেক কষ্ট হয়েছে। সারাদিনই বন্ধ ছিল রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ততম সড়কটি। তাই শান্তিপূর্ণ উপায়েই শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
সারাবাংলা/ইউজে/এমআই