জামানত হারিয়ে সিলেটে জামায়াতের ‘জারিজুরি ফাঁস’
৩১ জুলাই ২০১৮ ২২:০০
।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
সিলেট থেকে: সিলেটজুড়ে এখন টক অব দ্য টাউন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নাটকীয় ফল। একসঙ্গে তিন সিটিতে নির্বাচন হলেও সিলেটে হাড্ডাহাড্ডি এবং শেষ পর্যন্ত বিএনপি প্রার্থী আরিফুলের এগিয়ে থাকার নাটকীয়তা উত্তেজনা ছড়িয়েছে। তবে একইসঙ্গে আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন এই সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া জামায়াত ইসলামির প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়েরও। ‘সাংগঠনকিভাবে শক্তিশালী’ বলে পরিচিত সিলেটে মেয়র নির্বাচনে মাত্র ১০ হাজার ৯৫৪ ভোট পেয়ে জামানত হারানোর ঘটনা জামায়াতের সব দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নগরবাসী বলছেন, রিজার্ভ ভোট ব্যাংক বলে এতদিন জামায়াতের যে কৌশল ছিল, তার জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে। এর মাশুল গুনতে হতে পারে জাতীয় নির্বাচনে। জোটের রাজনীতিতেও সিলেট নির্বাচনের ফল ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
সোমবার (৩০ জুলাই) মধ্যরাতে ফল ঘোষণার শেষ দিকে মোবাইলে কথা হয় জামায়াতের মেয়র প্রার্থী, একসময়ের শিবির নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়েরর সঙ্গে। কত ভোট পেলেন— জানতে চাইলে কোনো উত্তর মেলেনি তার কাছ থেকে। জামায়াতের এ তরুণ নেতা কৌশলে একটি বিষয়ই বোঝাতে চেয়েছেন; তা হলো— স্থানীয় নির্বাচনে জোটভুক্ত থাকার বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
এ নির্বাচনে দিনভর বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র চোখে পড়েছে। ভোটারদের অনেকেও এমন নির্বাচন নিয়ে আক্ষেপ আর বিস্ময় জানিয়েছেন। সারাদিন রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে হোটেল কর্মচারী— সবার মুখে ছিল একটি কথা— নির্বাচনে কারচুপির অভিনবত্ব। তাদের ভাষ্য, রাজনৈতিক সম্প্রীতির সিলেটে এমন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন এর আগে কখনোই হয়নি।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী এ নির্বাচনকে ‘মীরজাফরি’ আখ্যা দিয়ে ফের নির্বাচনের দাবিও জানান। তবে সন্ধ্যার পর ফলাফলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শুরু হলে বিএনপি শিবিরে শুরু হয় ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ। রাত ৮টা নাগাদ শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে এলেও ১০টার পর থেকে শহর অনেকটাই সরগরম হতে শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি কর্মীদের জটলা, ব্যানার-পোস্টার হাতে উচ্ছ্বসিত অবস্থায় দেখা যায়।
ফলাফলের এমন চিত্রে হতচকিত হয়ে পড়েন বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীসহ দলের নেতাকর্মীরা। রাত ১০টার দিকে আরিফুল ছুটে যান নগরীর আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্রেক্সে রিটার্নিং কর্মকর্তার ফল ঘোষণা কেন্দ্রে। সেখানে সময় যত গড়াতে থাকে, জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হতে দেখা যায় তাকে।
সবশেষ ১৩২টি কেন্দ্রের ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে আরিফ পেয়েছেন ৯০ হাজার ৪৯৬ ভোট। নৌকা প্রতীকে কামরান পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৭০ ভোট। তাদের ভোটের ব্যবধান ৪ হাজার ৬২৬। সেখানে মেয়র পদে জামায়াত নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়ের পেয়েছেন ১০ হাজার ৯৫৪ ভোট।
সিলেটের রাজনীতিতে ‘শক্তিশালী অবস্থান’ রয়েছে বলে বরাবরই দাবি করে আসছে জামায়াত। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী এ নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী ঘোষণার পরও জামায়াত নিজের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল করলে তা আলোচনা উসকে দেয়। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে জয়ের বিষয়েও আশাবাদের কথা জোর দিয়ে জানান জামায়াতের জুবায়ের। শুধু তাই নয়, বিএনপির অনুরোধকে পাশ কাটিয়ে উল্টো তাকে সমর্থন জানিয়ে বিএনপির আরিফুলকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে জুবায়ের দাবি করেন, সিলেট নগরীতে জামায়াতের রিজার্ভ ভোট ৪৫ থেকে ৫০ হাজার। পাশাপাশি সাধারণ ভোটের হিসাব দেখিয়ে তিনিই বিজয়ী হচ্ছেন বলেও স্পষ্ট ঘোষণা দেন। রাজনীতি সচেনতরাও এসব হিসাব নিয়ে নজর রেখেছিলেন সিলেট সিটি নির্বাচনে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো— এই নির্বাচনে জামানত হারাচ্ছেন জামায়াতের এই প্রার্থী। কারণ, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা-২০১০–এর ৪৪ বিধির ৩ উপবিধি অনুযায়ী, কোনো নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের আট ভাগের একভাগ ভোট না পেলে একজন প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘোষণা অনুযায়ী এই নির্বাচনে ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২ ভোটের মধ্যে ভোট পড়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৭টি। সেই হিসাবে জামানত রক্ষার জন্য জুবায়েরের প্রয়োজন ছিল ২৪ হাজার ৮৩৩ ভোট। কিন্তু জুবায়ের পেয়েছেন ১০ হাজার ৯৫৪ ভোট। সিলেটে স্থগিত দুই কেন্দ্রের মোট ভোট ৪ হাজার ৭৮৭। ফলে এই দুই কেন্দ্রে সব ভোট পেলেও জামানত রক্ষা সম্ভব হবে না জুবায়েরের।
দিন শেষে নৌকা কিংবা ধানের শীষের ভাগ্যে কী ঘটলো, তার চেয়ে নগরবাসীর আলোচনায় উঠে এসেছে জামায়াতের করুণ পরিণতির বিষয়টি। ‘গুলি মিস হয়, জামায়াতের ভোট মিস হয় না’— প্রচলিত এমন বক্তব্য সত্যি হলে নগরীতে তাহলে জামায়াতের ভোট ব্যাংক কত? আর যদি তাদের দাবি সত্যি হয় কিংবা ৩০ থেকে ৩৫ হাজার রিজার্ভ ভোটের প্রচলিত ধারণাও যদি সত্যি হয়, তাহলে সেই ভোটগুলো কোথায় গেল? এসব প্রশ্ন মাথায় রেখেই নগরবাসী বলছেন, এমন সব বক্তব্য হয়তো ছিল জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশল, এই নির্বাচনে যার অসারতা ফুটে উঠেছে।
শনিবার নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন নগরীতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মিছিল জামায়াত করেছে বলে ভাষ্য প্রত্যক্ষদর্শীদের। তবে এ মিছিলের অংশগ্রহণকারীরা যে সবাই নগরীর ভোটার নয়, সে বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও সংখ্যানুপাতে ভোট পড়লেও দেয়ালঘড়িতে আরও ভোট পড়ার ছিল কথা বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। সেই ভোট না পড়ার অর্থ হলো— স্পষ্টতই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সিলেটবাসী জামায়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনে বিএনপির বাইরে গিয়ে প্রার্থী দেওয়া; ২০ দলীয় জোট, বিশেষ করে জোটের প্রধান বিএনপির অনুরোধ না রাখা এবং নির্বাচনে দলটির এমন ফলাফল সিলেটের রাজনীতিতে জামায়াতকে গর্তে ঢুকিয়ে দেবে। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রশাসনিক জটিলতা মোকাবিলায় দলটিকে আরও অসহায় করে তুলবে। এমন ঘটলে সিলেটে কথিত প্রতাপ কিংবা প্রভাবে আর প্রভাবিত হবে না কেউ।
আরও পড়ুন-
বোঝেননি কামরান, বোঝেননি আরিফুল
রাজশাহী-বরিশালে মেয়র নৌকার, দৃশ্য পাল্টে সিলেটে এগিয়ে ধানের শীষ
সারাবাংলা/এমএস/এএস/টিআর